Logo
Logo
×

বাংলার মুখ

যুবলীগ নেতার বালু ব্যবসা

মাদারীপুরে নদী ভাঙনসহ শতকোটি টাকার সেতুর ক্ষতির আশঙ্কা

Icon

টেকেরহাট (মাদারীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাদারীপুর সদর উপজেলার হবিগঞ্জ সেতুর মাত্র ৫০ মিটার দূরে রমরমা বালু ব্যবসা করছেন বাহাদুরপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি ও ইউপি সদস্য শফিকুল বেপারী দেদুল। সেতুর কিছুটা দূরে আড়িয়ালখাঁ নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে সেতুর সঙ্গেই দুটি ব্যারাজ নির্মাণ করে বালুর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। প্রশাসনের চোখের সামনে এমন রমরমা ব্যবসা চললেও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিতে পারে। আর শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হবিগঞ্জ সেতুর পূর্বপাশসংলগ্ন বালু রাখার জন্য বড় আকারের দুটি ব্যারাজ নির্মাণ করা। যেখানে আড়িলায়খাঁ নদ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে বাল্কহেডের মাধ্যমে আনলোড করা হচ্ছে। যে স্থানে বালু জমানো হচ্ছে তার মাত্র ৫০ ফুট দূরেই সেতুটি। ফলে বালু উত্তোলন ও আনলোডের কারণে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভাঙন দেখা দিয়েছে নদীর পিলারের স্থানে। একের পর এক বাল্কহেড বালু নিয়ে আসছে, আবার তা ফেলে ফিরে যাচ্ছে। অন্যদিকে সে বালু পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনই হুলুস্থুল কাণ্ড দেখা যাচ্ছে গত দুই মাস ধরে। স্থানীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সেতুর সঙ্গে বালু স্তূপ করা ব্যারাজ দুটির বছর দুই আগেও নিয়ন্ত্রণ ছিল মাদারীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাহাদুরপুর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সেলিম ও তার ছেলে সৈয়দ রাজিবের। তারা এ স্থানে বালু স্তূপ করে রমরমা ব্যবস্থা করতেন। এদের স্থানীয়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামের ফজলুল হক বেপারীর ছেলে ও ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি শফিকুল বেপারী দেদুল। যিনি বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য। এরা মিলেই বালুর অবৈধ ব্যবসা করে আসছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সেলিম ও তা ছেলে সৈয়দ রাজিব। এরপর বেশ কিছুদিন বালু ব্যবসা বন্ধ ছিল। কিন্তু গত দুই মাস ধরে পুনরায় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে নেন শফিকুল বেপারী দেদুল ও স্থানীয় রুহুল মিয়া। তাদের নিয়ন্ত্রণেই এখন চলছে ব্যবসা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন স্থানীয় লোক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের মামুন নামে এক ব্যক্তির ড্রেজার দিয়ে আড়িয়ালখাঁ নদের অন্তত পাঁচটি স্থান থেকে দিন-রাত বালু উত্তোলন করা হয়। আর সে বালু ফেলা হচ্ছে দেদুলের ব্যারাজে। পরে এসব বালু রাতের আঁধারে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। অবৈধভাবে উত্তোলন করা এসব বালু বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বালু পরিবহণে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাক্টরও। ফলে ভেঙে যাচ্ছে চলাচলের রাস্তা। অন্যদিকে সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন সেতু দিয়ে হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করায় স্থানটি সবার চোখে পড়ছে। কিন্তু এরপরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, দেদুল মেম্বার এতোটাই প্রভাবশালী, তার বিষয়ে কথা বলতে সবাই ভয় পান। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা করা হয়। সপ্তাহখানেক আগে দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামের ইঞ্জিল হকের ছেলে লিয়াকত হক প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করে দেদুলের লোকজন। ফলে অন্যরা কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। এলাকায় অলিখিত ত্রাস দেদুল মেম্বার। নাম প্রকাশে অনুচ্ছিক এক ব্যক্তি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলেও ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতারা বালুর ব্যবসা করতেন, এখনো তারাই কৌশলে বালুর ব্যবসা করছেন। সঙ্গে বিএনপির কিছু লোক জড়িত হচ্ছেন। এখন আর আগের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়। বরং এখন প্রশাসন ম্যানেজ করেই তারা কাজ করতে পারছেন। বালু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমেনি বরং আগের চেয়ে বেড়েছে।’ এলজিইজির অর্থায়নে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে আড়িয়ালখাঁ নদের ওপর হবিগঞ্জ ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। যার অন্তত দুই হাজার মিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করার নিয়ম নেই। কিন্তু ব্রিজের মাত্র ৫০০ মিটার দূরেই অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ব্রিজেরও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সানাউল কাদের খান। তিনি বলেন, ‘নিয়ম হলো সেতুর অন্তত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মিটার দূরে নদীর পলি অপসারণ করার। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় সেতুর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। তা না হলে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর ক্ষতি হবে।’ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাবাব ওয়াদিয়া বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন যেহেতু জেনেছি, খুবই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আমরা প্রতিনিয়ত অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বালু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা করছি। এসবও বন্ধ করা হবে।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে শফিকুল বেপারী দেদুলের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম