কাজে আসছে না বজ্রপাত নিরোধক
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন, হবিগঞ্জ
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা হাওড় ও বনাঞ্চলবেষ্টিত। ফলে এসব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাত এক আতঙ্কের নাম। বজ্রপাতে জেলায় প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ জন মারা যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বজ্রপাত রোধে জেলায় ৩৩টি বজ নিরোধক বা লাইটিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। অথচ এসব যন্ত্র কোনো কাজেই আসছে না। এসব যন্ত্র এখন পর্যন্ত কোথাও বজ্রপাত নিরোধ করতে পেরেছে কি-না তা বলতে পারছেন না কেউই। এগুলো কোনো কাজ করে কি-না তাও জানা নেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। কিছু বসানো হয়েছে উপজেলা অফিসের সামনে, আবার কিছু সাবেক এমপির বাড়ির সামনে। এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আজাদের রহমান বলেন, ‘এ যন্ত্রগুলো আমি এখানে যোগদানের পূর্বে বসানো হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে আমাদের কারও কোনো ধারণা নেই। যে কোম্পানি এগুলো স্থাপন করেছে, তারাই এ বিষয়ে বলতে পারবে। তবে কোম্পানির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি। তারা একজন আরেকজনকে দেখান। ফোন দিলে ধরেন না।’ তিনি জানান, এটি চতুর্পাশ্বে ১০৭ মিটার করে কাভার করার কথা। কিন্তু কোনো কাজ করে কি-না তা তার জানা নেই। এর মধ্যে ব্যাটারি আছে। সেগুলো চার্জ আছে কি-না তাও দেখার কোনো উপায় নেই। এটিও আমরা জানি না। এছাড়া এগুলো হাওরে স্থাপন করলে মেইনটেনেন্স করা সম্ভব নয়। তাই হাওরে এটি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বরং হাওরে যদি আশ্রয়কেন্দ্র করা যায় সে ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে। মানুষও বজ্রপাত থেকে বাঁচতে পারবে। বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুর গ্রামের আব্দুল মতিন বলেন, সাবেক এমপি মজিদ খান তার বাড়ির সামনে এনে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসিয়ে দিয়েছেন নিজে বাঁচার জন্য। আর হাওরে মানুষ বজ্রপাতে মরে। কি লাভ হলো, এখন তিনি নিজেই কারাগারে আছেন। একই গ্রামের আব্দুল মোতালিব বলেন, এগুলোতে বাতি জ্বলার কথা। কিন্তু কখনো কোনো বাতি জ্বলতে দেখিনি। এটি কোনো কাজ করে কি-না তা কেউ জানেন না। এ যন্ত্রের পাশেই আমার বাড়ি কিন্তু কদিন আগেই আমার বাড়িতে বজ্রপাত হয়েছে। অল্পের জন্য আমরা রক্ষা পেয়েছি। তাহলে টাকা খরচ করে এসব বসিয়ে লাভ কি। আসলে যন্ত্র বসানোর নামে ধোঁকা দিয়ে টাকা লুটপাট করা হয়েছে। হাওড়াঞ্চলের মানুষের জীবযাত্রা নিয়ে কাজ করা তারেক খান বলেন, বজ্রপাতে বেশির ভাগ মানুষই মারা যান হাওরে। কিন্তু দেখা গেল কি- একটি যন্ত্রও হাওরে বসানো হয়নি। সবই কোনো সরকারি অফিসের আশপাশে, বাড়ির আশপাশে, সাবেক এমপিদের বাড়ির পাশে বসানো হয়েছে। তাতে হাওড়বাসীর কী লাভ হলো। লক্ষ্য তো অর্জিত হলো না। তাছাড়া যন্ত্রগুলোও মনে হচ্ছে অকার্যকর। অনেক স্থানেই দেখা যাচ্ছে যন্ত্রের পাশেই বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি লুটপাটের ফন্দি ছাড়া কিছুই নয়। হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহম্মদ বলেন, বজ্রপাত মূলত বর্ষা মৌসুমের শুরু এবং
শেষাংশে হয়। আর বজ্রপাত যখন হয়, তখন এটি কাছাকাছি বিদ্যুৎ পরিবাহিত যা পায় তা দিয়েই মাটিতে স্পর্শ করে। এক্ষেত্রে উঁচু গাছ হিসাবে তাল গাছ অত্যন্ত কার্যকরী। কিন্তু এটি তো বাড়তে দীর্ঘ সময় লাগে। নার্সারির গাছগুলো দেখা যায় বাঁচে না। আবার লাইটিং
অ্যারেস্টার খুবই ব্যয়বহুল। তাছাড়া এটি রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন। এক্সপার্ট প্রয়োজন। কার্যকারিতা কতটুকু সে সম্পর্কেও বুঝতে হবে। তাই এটির পরিবর্তে প্রয়োজন জনসচেতনতা বাড়ানো। স্বল্প ব্যয়ে যাতে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়, সে পদ্ধতি বের করতে হবে। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জেলায় গত ছয় বছরে (চলতি মৌসুমসহ) বজ্রপাতে মারা গেছেন ৮৪ জন। প্রতিবছর গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মাঝে চলতি বছর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন তিনজন। আর সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ২০২২ সালে। ওই বছর মারা যান ২২ জন। আহত হন তিনজন। ২০২০ সালে মারা যান ১৫ জন, আহত হন চারজন। ২০২১ সালে মারা যান ১২ জন, আহত হন দুজন। ২০২৩ সালে মারা যান ১২ জন, আহত হন একজন এবং ২০২৪ সালে মারা যান ১২ জন, আহত হন দুজন। এ অবস্থায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০ লাখ, বানিয়াচংয়ে ৪৫ লাখ, আজমিরীগঞ্জে ৩০ লাখ, হবিগঞ্জ সদরে ১৫ লাখ, লাখাইয়ে ২৫ লাখ, শায়েস্তাগঞ্জে ১০ লাখ, চুনারুঘাটে ১৫ লাখ এবং মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়ে ৯টি উপজেলায় ৩৩টি লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এর মাঝে নবীগঞ্জে ছয়টি, বাহুবলে দুটি, বানিয়াচংয়ে সাতটি, আজমিরীগঞ্জে ছয়টি, হবিগঞ্জ সদরে তিনটি, লাখাইয়ে তিনটি, শায়েস্তাগঞ্জে দুটি, চুনারুঘাটে দুটি ও মাধবপুরে দুটি। এগুলো ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই স্থাপন করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় মোট হাওড় আছে এক হাজার ৯৫ বর্গকিলোমিটার। পুরো হাওড় লাইটিং অ্যারেস্টার বা বজ নিরোধক যন্ত্রের আওতায় আনতে হলে মোট ৩০ হাজার ৬৬০টি যন্ত্রের প্রয়োজন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৮টি করে)। এতে ব্যয় দাঁড়াবে দুই হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আজমিরীগঞ্জে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানো হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশে। কোনোটি বসানো হয়েছে বাড়িঘরের কাছাকাছি।
বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুরে বসানো হয়েছে সাবেক এমপি (বর্তমানে কারান্তরীণ) আব্দুল মজিদ খানের বাড়ির সামনে। একটি যন্ত্রেরও কোথাও বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। হাওরের কোথাও একটি যন্ত্র স্থাপন করতে দেখা যায়নি।
