Logo
Logo
×

বাংলার মুখ

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

ভেস্তে গেল কৃষকের স্বপ্ন

৪১ কোটি টাকার কফি-কাজুবাদাম চাষ প্রকল্পে দুর্নীতি

Icon

মোহাম্মদ ইলিয়াছ, বান্দরবান (দক্ষিণ)

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নেওয়া কফি-কাজুবাদাম চাষ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। প্রায় ৪১ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে পদে পদে হয়েছে দুর্নীতি ও লুটপাট। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের সম্ভাবনাময় কফি ও কাজুবাদাম চাষ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুনে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ খাত বাস্তবায়ন হয়নি। মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ বাগানের অস্তিত্বই নেই। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের জামিনী পাড়া, রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের প্লেদয় ম্রো পাড়া, ছাংও পাড়া, রুমার বটতলী পাড়া ও ময়ুর পাড়ার অধিকাংশ বাগান ইতিমধ্যেই জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কোথাও পানির ট্যাংক থাকলেও অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।

বটতলী পাড়ার কফি চাষি ক্যসাচিং মারমা জানান, ‘এই পাড়ায় ২১ জন উপকারভোগীর মধ্যে শুধু আমার বাগানে কিছু গাছ টিকে আছে। অফিস থেকে লোকজন এসে বিভিন্ন সাইনবোর্ড নিয়ে আমার বাগানে ছবি তুলে গেছে, যেন সব বাগানই আছে।’ ময়ূর পাড়ার নারী চাষি মুইংক্য মারমা বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে পানি সংকট থাকলেও কোনো সেচ সুবিধা পাইনি। যে চারা দেওয়া হয়েছিল, তার বেশিরভাগই মরাধরা ছিল। এমন দায়সারা প্রকল্প জানলে আগে নামই লিখতাম না।’

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রথমে ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হলেও পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ কোটি ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এর আওতায় তিন পার্বত্য জেলার ১২ উপজেলায় দুই হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারকে কফি ও কাজুবাদাম চাষে সম্পৃক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ-প্রকল্পের নামেই হয়েছে কেবল কার্যক্রম। কৃষকদের দেওয়া হয়েছে অপরিপক্ক, ক্ষতিগ্রস্ত চারা। প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি নথি অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, কৃষক প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থা, ড্রিপ ইরিগেশন, বাঁধ নির্মাণ, পানি সংরক্ষণের ট্যাংক, প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিনসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ খাতের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বরং বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিন অনিয়মের বিষয় স্বীকার করে বলেন, ‘প্রকল্প চলমান থাকাকালীন বেশ কিছু খাত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এজন্য ৪১ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে।’ তবে কোন খাতের কত টাকা ফেরত গেছে, সে বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ২০১৫ সালে মিশ্র ফল চাষ প্রকল্প, ২০১৭ সালে আয়বর্ধক কর্মসূচি, ২০১৮ সালে উচ্চমূল্যের মসলা চাষ প্রকল্প এবং ২০১৯ সালে তুলা চাষ প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। শতকোটি টাকা ব্যয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেগুলো থেকেও কৃষকরা কোনো সুফল পাননি। রোয়াংছড়ির প্লেদয় ম্রো পাড়ার এক চাষি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা প্রতিবারই আশায় বুক বাঁধি যে সরকার প্রকল্প দিলে হয়তো ভাগ্য বদলাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু কাগজে-কলমেই সব শেষ হয়ে যায়।’ স্থানীয় উন্নয়নকর্মীদের মতে, পাহাড়ের অনুকূল আবহাওয়া ও মাটি কফি-কাজুবাদাম চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিন পার্বত্য জেলার হাজারো পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারতো। অথচ অনিয়ম-দুর্নীতি পাহাড়ের সেই স্বপ্নকেই করেছে ভঙ্গুর।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম