সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি
রাঙ্গাবালীতে ঠিকাদারের নকশাবহির্ভূতভাবে কাজ মানহীন সামগ্রী ব্যবহার
কামরুল হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে ৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি সড়ক নির্মাণে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিময়-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মাণ কাজের শুরু থেকেই ঠিকাদারের লোকজন নকশাবহির্ভূতভাবে কাজ করার পাশাপাশি মানহীন সামগ্রী ব্যবহার করছেন। সবার চোখের সামনে ঠিকাদার কাজ ফাঁকি দিয়ে প্রকল্পের টাকা লোপাট করছেন বলেও দাবি স্থানীদের। কিন্তু সব দেখেও না দেখার ভান করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গাবালী উপজেলার কাছিয়াবুনিয়া লঞ্চঘাট বাজার থেকে বাহেরচর বাজার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০৯ টাকায় কাজটি পায় রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সাব-ঠিকাদার হিসাবে কাজটি করছেন দশমিনা উপজেলা সদরের বাসিন্দা জুয়েল মোল্লা। এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুরু হওয়া এ কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ। ৬০০ মিটার সড়ক আরসিসিকরণ কাজ শেষ হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নির্মাণের শুরু থেকে মানসম্মত কাজ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যতটুকু কাজ হয়েছে পুরোটাতেই অনিয়ম হয়েছে। কাজ শেষ হতে না হতেই পাথর উঠে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তারা। ফলে সড়কটির স্থায়ীত্ব নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে এর প্রমাণও পায় যুগান্তরের এই প্রতিবেদক। সড়ক নির্মাণ কাজ চলাকালীন সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঢালাই চলছে। কিন্তু এই ঢালাইয়ে ব্যবহৃত পাথর ও বালুতে মিশে আছে কাদামাটি। ঢালাইয়ে ব্যবহার করা হয় জমাট বেঁধে চাক চাক হয়ে যাওয়া সিমেন্টও। তা দিয়েই চলছিল ঢালাইয়ের কাজ।
মানহীন সামগ্রী দিয়ে কাজ চলার কথা স্বীকারও করেন নির্মাণ শ্রমিকরা। ঢালাই কাজে নিয়োজিত শ্রমিক সরদার ওয়াহাব হোসেন বলেন, ‘আমাদের কন্ট্রাক্টর (ঠিকাদার) নির্দেশ করছে, আমরা এভাবেই পুরো কাজ করেছি। আমরা দেহি (দেখছি) অর্ধেক পাথরের সঙ্গে অর্ধেক কাদা। পাথরের সঙ্গে মাটি আমরা দেখতেছি। বালুর সঙ্গেও মাটি।’
শুধু মানহীন সামগ্রী ব্যবহার করেই ক্ষ্যান্ত হননি ঠিকাদার! রড সাশ্রয় করতে নকশাবহির্ভূত কাজ করার প্রমাণও মিলেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে। নকশা অনুযায়ী, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ৭ ইঞ্চি পরপর ঢালাইয়ের জন্য ১০ মিলি. রড দিয়ে জালি করার কথা। কিন্তু রড সাশ্রয় করতে ঘনত্ব কমিয়ে দুই ইঞ্চি ফাঁকা বেশি দিয়ে ৯ ইঞ্চি পরপর রড বেঁধে জালি করা হয়েছে। সেই জালির ওপর ঢালাই দেওয়া হচ্ছিল।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সরাসরি স্বীকারোক্তি দেন কাজের মূল রাজমিস্ত্রি আলমগীর হোসেন।
সড়ক নির্মাণ কাজের সাব-ঠিকাদার দশমিনা উপজেলা সদরের বাসিন্দা জুয়েল মোল্লা মোবাইলে বলেন, ‘আমি বলছি ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করতে। ডিজাইনের বাইরে কাজ করতে নিষেধ করেছিলাম।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদার আমাদের জানিয়ে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু সোমবার আমাকে অবগত না করে কাজটি শুরু করেছিল। বিষয়টি শুনে আমার প্রতিনিধি গিয়ে কাজটি বন্ধ করে। যেহেতু আমাদের না জানিয়ে ডিজাইনের বাইরে কাজটি করছিল, সেক্ষেত্রে ঠিকাদারকে আমরা বলে দিয়েছি ডিজাইন অনুযায়ী ঢালাই প্রস্তুত করতে। আমরা পরীক্ষা করব, তারপর কাজ করব।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব দাশ পুরকায়স্থ বলেন, ‘সড়ক নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টি জেনে আমি ইতোমধ্যে উপজেলা প্রকৌশলীকে বলেছি। উনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ ধরনের উন্নয়ন কাজে কোনো ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ঠিকাদার কিংবা যে কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
