গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাজমুল লাবিব
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ঐতিহ্য আর গৌরবের এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারক এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই, সে সময়কার ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবনগুলো ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে জ্ঞান-গবেষণার এ পাদপীঠ। কলা, বিজ্ঞান ও আইন-এ ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। কলা অনুষদভুক্ত বিভাগ ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি বিভাগ। বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ছিল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও গণিত বিভাগ। আইন অনুষদের অধীনে আইন বিভাগ। প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা হল, মুসলিম হল এবং জগন্নাথ হল নামে তিনটি আবাসিক হল ছিল। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রদেশ পূর্ববঙ্গের বা পরবর্তী সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। ভারত বিভক্তির ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি মুক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের সংখ্যা একটি ছাত্রী হলসহ ৮টিতে উন্নীত হয়।
শুধু একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমই নয়, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের সব জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থী শহীদ হন। সম্প্রতি ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের ১৯৬১ সালের জারিকৃত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকরা দাবি করে আসছিলেন। তাদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতাপরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ জারি করা হয়। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চাসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬১টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র, ৫টি ছাত্রী হলসহ মোট ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল এবং ১৯৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার ৩৩৯ জন এবং পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ১৭৭ জন শিক্ষক। গত ৮ জুন ২০২৫ পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত ট্রাস্ট ফান্ডের সংখ্যা ৩৯২টি। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে বর্তমানে চার বছর মেয়াদি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া দুবছর মেয়াদি এমফিল এবং চার বছর মেয়াদি পিএইচডি ও ডিবিএ ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের অধীনে বিভিন্ন মেয়াদি প্রফেশনাল কোর্স পরিচালনা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুবাশ্বির আলম বলেন, বাঙালি মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও পূর্ববাংলার অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে লক্ষ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শত বছরের যাত্রায় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে কিছু ব্যর্থতাও দেখা গেছে। যেমন-শতবর্ষ পার হলেও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে না পারা, রাজনৈতিক প্রভাব, দলাদলি, গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত আন্তর্জাতিক মান বজায় না রাখা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব ইত্যাদি। এসব বিষয়ে যদি সমাধান করা যায় তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং-এ ভালো করবে।
শাখাওয়াত হোসেন সাকু নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু আমাদের শিক্ষার কেন্দ্র নয়, এটি আমাদের চিন্তা, অধিকার আর প্রতিবাদের জায়গা। একশ বছর আগে যে উদ্দেশ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমরা মনে করি আজও সেটি প্রাসঙ্গিক। সময়ের বিবর্তনে এ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই আজ অনেক অর্জন সম্ভব হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য-দেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার নেতৃত্বে এখানকার সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তবে কিছু সমালোচনাও আছে। সময়ের সঙ্গে গবেষণার মানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক দলীয়করণ, প্রশাসনিক অদক্ষতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং শিক্ষার গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটির মূল চেতনা এবং শিক্ষার পরিবেশ কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজও দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষার প্রতীক এবং জাতীয় চেতনার বাতিঘর। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পেরিয়ে ভবিষ্যতে আরও আধুনিক, গবেষণাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠার প্রত্যাশা সবার।
