Logo
Logo
×

ক্যাম্পাস তারুণ্য

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

বিদ্রোহী চেতনায় দীপ্ত অভিযাত্রা

Icon

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ত্রিশালের সবুজে মোড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যেখানে নজরুলের স্মৃতি অনুরণিত হয় আজও; সেই সবুজ ভূখণ্ডেই গড়ে উঠেছে দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিদ্রোহী কবির কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত এ জনপদে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। যা আজ শুধু একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং হয়ে উঠেছে মানবিকতা, প্রতিবাদ ও সাম্যের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার এক প্রাণবন্ত চারণভূমি। এখানকার শিক্ষা, গবেষণা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শরীফুল ইসলাম

ত্রিশালের নামাপাড়া বটতলা, যেখানে বটগাছের নিচে বসে গান ও কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে নজরুলের শিক্ষা ও ভাবনার এক নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঠিক সেখানেই আজ জেগে উঠেছে উচ্চশিক্ষার এক নতুন প্রেরণা-নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯১৪ সালে, কাজী নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহের ত্রিশালে আসেন। দরিরামপুর স্কুলে পড়াশোনা করতে এসেই এ জনপদের মাটিতে রাখেন তার সাহসী পদচিহ্ন। অল্প সময়ের বসবাস হলেও ত্রিশাল তার জীবনের স্মৃতিময় এক অধ্যায় হয়ে ওঠে। এখানকার প্রকৃতি, মানুষ ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে তার সাহিত্যেও নানা প্রভাব ফেলে। ত্রিশালের বুকজুড়ে আজও অম্লান হয়ে আছে নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন; যেন ইতিহাস কথা বলে।

ঐতিহাসিক অভিযাত্রা

১৯৯০-এর দশকে ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম নজরুলের নামে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে এবং সেই দাবিকে সংগঠিত করে। ২০০৪ সালে একনেকের বৈঠকে প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০০৫ সালের ১ মার্চ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে সূচনা হয় এর ঐতিহাসিক যাত্রার। ২০০৬ সালের ২৫ মে দুটি অনুষদের ভবন উদ্বোধন হয় এবং ২০০৭ সালের ৩ জুন থেকে প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় প্রায় দুদশকের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে এ বিদ্যাপীঠের গর্বিত যাত্রা।

২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি জন্মলগ্ন থেকেই নজরুলের আদর্শ, চেতনা ও সৃজনশীলতার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। এর প্রতিটি ভবন, করিডর, পাঠাগার কিংবা খোলা প্রাঙ্গণে যেন ছড়িয়ে আছে বিদ্রোহী কবির কাব্যিক স্পর্শ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় নজরুলের মানবতাবাদ, সাম্যবোধ ও মুক্তচিন্তার মন্ত্র। শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নকে লক্ষ্য করে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় অল্প সময়েই এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। শুধু জ্ঞানচর্চার নয়, এটি নজরুল-চেতনাভিত্তিক এক প্রেরণার কেন্দ্র।

শিক্ষা কার্যক্রম

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২৫টি বিভাগে পাঠদান কার্যক্রম চলমান। শিক্ষার্থীরা এখানে বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন, চারুকলা এবং কলার বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পান। দীর্ঘ বিশ বছরের পথচলায় সংকট-সম্ভাবনা সবকিছু মিলিয়ে নজরুলের আদর্শে গড়া সমৃদ্ধ এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে দুটি (নতুন ও পুরোনো) প্রশাসনিক ভবন।

নজরুলকে নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। তবে শিক্ষার্থীরা যে বিভাগেই পড়ুক, নজরুলের চেতনা ও আদর্শ সব শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি বিভাগেই প্রথম বর্ষে ‘নজরুল স্টাডিজ’ নামে একশ নম্বরের বাধ্যতামূলক একটি কোর্স পড়ানো হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে প্রতি বছর গবেষণা মেলা, আন্তর্জাতিক কনফারেন্স প্রভৃতি আয়োজন করে থাকে।

নান্দনিক অবকাঠামো

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চারটি আবাসিক হল। হলগুলোয় প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পেয়ে থাকে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও দুটি আবাসিক হল নির্মাণাধীন রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে ছয়টি আবাসিক ভবন এবং নির্মাণাধীন রয়েছে আরও একটি আবাসিক ভবন। কর্মচারীদের জন্য রয়েছে একটি আবাসিক ভবন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্থাপিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় মসজিদ। এ ছাড়াও রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, নজরুলের একটি ভাস্কর্য, দুটি ম্যুরাল ও সংবিধান আঙিনা।

নজরুলময় ক্যাম্পাস

এ ক্যাম্পাসে প্রতিটি পদচারণায় কবির নাম, ছবি আর তার অমর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন করে পরিচিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলকে জানার ও বোঝার নানা সুযোগ রয়েছে। শুধু নামে নয়, বিভিন্ন স্থাপনা, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও কর্মযজ্ঞে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের নাম ও স্মৃতি ব্যবহার করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টিই নজরুলময় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে উঠেছে। কবির ডাকনামে উপাচার্যের বাসভবনের নামকরণ করা হয়েছে ‘দুখু মিয়া’ বাংলো। বাংলোর ফটক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে কবির একটি করে ম্যুরাল। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কবি নজরুলের দৃষ্টিনন্দন একটি ভাস্কর্য।

বিদ্রোহী কবিতার লাইন থেকে নিয়ে শহিদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের নামকরণ করা হয়েছে ‘চির উন্নত মম শির’। দুটি ছাত্র হলের প্রথমটির নাম নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’ নামে এবং অপরটি নামকরণ করা হয়েছে কবির বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ নামে। অপরদিকে ছাত্রী হল দুটির নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘দোলনচাঁপা’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘শিউলিমালা’ নামে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করে ‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতু’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘প্রভাতী’, ‘বাঁধনহারা’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘দক্ষিণ হাওয়া’, ‘সওগাত’, ‘সাম্যবাদী’ প্রভৃতি নামের বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে ‘গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ’, ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’ ও ‘জয়ধ্বনি মঞ্চ’। কবি নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রামের নামে নামকরণ করা হয়েছে ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’। অন্যদিকে ‘গাহি সাম্যের গান’ ও ‘জয়ধ্বনি’ শব্দ দুটি চয়ন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণও করা হয়েছে কবি পরিবারের সদস্যদের নামানুসারে, যেমন-‘প্রমিলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’, ‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’। অনুষ্ঠানে নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ ও গবেষণাকর্মে অবদান রাখার জন্য দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘নজরুল পদক।’

উচ্চতর গবেষণাকর্ম

নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপর উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ এবং ইরানের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে দুই বাংলায় কবি নজরুলের নামাঙ্কিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা চুক্তি।

সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন

জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যাপীঠ শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়-এ যেন বাঙালির সংস্কৃতি ও চেতনার এক প্রাণময় মঞ্চ। এখানে শিক্ষার পাঠের পাশাপাশি বছরজুড়ে চলে সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন ধারা-উৎসব, আবৃত্তি, নাটক, গান, চলচ্চিত্র, সাহিত্যচর্চা, সবকিছুর সম্মিলনে এটি হয়ে উঠেছে এক ঐক্যবদ্ধ সৃজনভূমি। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে থাকবে না, বরং নজরুল চেতনাকে পাথেয় করে এটি হয়ে উঠবে একটি আলোকিত, মানবিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জাগ্রত সমাজ নির্মাণের অন্যতম পথপ্রদর্শক।

উপাচার্যের অভিব্যক্তি

নজরুল কেবল একজন কবি নন, তিনি একটি চেতনার নাম। ত্রিশালের সবুজ আকাশে যার বিদ্রোহী স্বপ্নের দীপ্তি প্রতিফলিত হয় প্রতিনিয়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, নজরুলের যে বিশালতা, সৃষ্টির যে ব্যাপকতা-এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আরও গভীরভাবে অনুধাবন করেছি। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক অসাধারণ প্রতিভা ছিলেন নজরুল। ত্রিশালের মানুষ তাকে নিজেদের সন্তান হিসাবে গর্বের সঙ্গে মনে রাখে। তার স্মৃতিচিহ্ন এ অঞ্চলের নানা স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। ময়মনসিংহ তথা ত্রিশাল যেন এক নজরুলময় অঞ্চল। তিনি আরও বলেন, কলকাতায় যেমন শান্তিনিকেতন হয়েছে, তেমনি আমরাও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নজরুল নিকেতন’ হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। সরকারের ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহযোগিতায় আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরুল চিন্তা ও দর্শনের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলব-এ লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম