ওয়ার্ড পরিক্রমা (দক্ষিণ সিটি): ২৯ নম্বর ওয়ার্ড
ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন
অপরিকল্পিত ভবনে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি * প্লাস্টিক কারখানায় বায়ুদূষণ : অতিষ্ঠ জীবন * অপ্রশস্ত সড়কে লেগেই থাকে যানজট
ছবি: যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া সংকীর্ণ গলি এবং রাজউকের অনুমোদনবিহীন ভবনে এই এলাকা গিজগিজ করছে। অনেক প্লাস্টিক, জুতা ও কসমেটিক কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। পলিথিন কারখানায় বাড়ছে বায়ুদূষণ। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগে চলছে এসব বেশির ভাগ কারখানা। যেগুলোর অধিকাংশই আবাসিক ভবনের নিচতলায় গড়ে তোলা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে আগুন ধরে যেতে পারে-এমন ঝুঁকি মাথায় নিয়েই প্রতিদিন বসবাস করছে এখানকার মানুষ। ড্রেনেজব্যবস্থা নাজুক, অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটুসমান পানি জমে যায় গলিতে। অপ্রশস্ত সড়কে লেগেই থাকে যানজট।
ওয়ার্ড পরিচিতি : ডিএসসিসি অঞ্চল-৩ এর আওতাধীন ২৯ নম্বর ওয়ার্ড। আগে এটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড ছিল। ওয়ার্ডটি ঢাকা মহানগর পুলিশের চকবাজার থানার অন্তর্গত ও জাতীয় সংসদের ঢাকা-৭ আসনের আওতায় পড়েছে। ওয়ার্ডের অন্তর্গত এলাকাগুলো হলো-ইসলামবাগ, শায়েস্তা খান রোড, রহমতগঞ্জ লেন, হাজী রহিম বক্স লেন, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, হাজী বালু রোড, গণি মিঞার হাট ও ফরিয়াপট্টি।
সরেজমিন দেখা যায়, ওয়ার্ডের ইসলামবাগ এলাকাজুড়ে সংকীর্ণ গলি, ভাঙাচোরা রাস্তা, নাজুক ড্রেনেজব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামবাগের বাবুল কমিশনারের গলিতে অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটুসমান পানি জমে, দুর্গন্ধে টেকা দায়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য প্লাস্টিক, পলিথিন ও বিস্কুট কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। রাজউকের অনুমোদনবিহীন ভবন আর অগোছালো বৈদ্যুতিক তারে এলাকাজুড়ে অগ্নিঝুঁকি চরমে। গলিগুলো এতটাই সরু যে বড় কোনো গাড়ি ঢোকাই যায় না। শায়েস্তা খান রোডে দীর্ঘদিনের ভাঙাচোরা রাস্তায় এখন সিটি করপোরেশনের কাজ চললেও জনদুর্ভোগ রয়ে গেছে আগের মতোই। রহমতগঞ্জ লেন থেকে ডালপট্টি-মোর, চাঁদনীঘাট হয়ে পোস্তামোর পর্যন্ত সড়কজুড়ে খানাখন্দ, ড্রেনেজের বেহাল দশা, খুঁটির তারে জটলা আর পাগলা কুকুরের আতঙ্ক। হাজী রহিম বকস লেনে ভাঙা সড়ক ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। ওয়াটার ওয়ার্কস রোডে কাটারা কমিউনিটি সেন্টার থেকে পোস্তারমোর পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে গর্ত ও ধুলোবালি। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকে না, গভীর রাতে কিছুটা চাপ ফিরে আসে। হাজী বালু রোড এলাকায় রাজউকের অনুমোদনবিহীন ভবন আর প্লাস্টিক কারখানায় ভরা গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জরাজীর্ণ তার। ময়লা-আবর্জনা সময়মতো পরিষ্কার হয় না। মশার ওষুধও দেয় না সিটি করপোরেশন। সড়কের বাতিগুলোও নষ্ট। গণি মিঞার হাট এলাকায় পলিথিন ও প্লাস্টিক দানার কারখানায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে চলছে উৎপাদন। এখানে অগ্নিঝুঁকি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই মশা আর পাগলা কুকুরের আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি থাকে। ফরিয়াপট্টি এলাকায় সিটি করপোরেশন সম্প্রতি রাস্তাঘাট সংস্কার করলেও ড্রেনেজ সমস্যা আগের মতোই রয়েছে। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা আর মশার উৎপাত এলাকাবাসীর ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।
৭২ বছর বয়সি ইসলামবাগের বাসিন্দা মোহাম্মদ আয়নাল হক যুগান্তরকে বলেন, আমি আইয়ুব খানের আমল থেকে এ এলাকায় বসবাস করি। তখন খোলা জায়গা, খাল-বিল, গাছপালা ছিল। এখন শুধু ভবন এবং কারখানা। নিচতলায় প্লাস্টিক, জুতা, কসমেটিকস, পলিথিনের কারখানা, ওপরে মানুষ থাকে। এসব ভবনের রাজউকের কোনো অনুমোদন নেই। রহমতগঞ্জ লেনের বাসিন্দা মো. হানিফ মিয়া যোগ করে বলেন, এলাকায় অগ্নিঝুঁকি ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। বৈদ্যুতিকসহ বিভিন্ন তারের জট, অবৈধ লাইন, রাস্তা এত সরু যে আগুন লাগলে দমকল ঢুকতে পারবে না। অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগে রাতভর কারখানার কাজ চলে। আবাসিক এলাকায় এসব শিল্পকারখানার কারণে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, নির্বাচনের আগে নানা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়, কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের এই দুরবস্থা থেকে তারা মুক্তি মিলে না।
ইসলামবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. জসিম বলেন, ওয়ার্ডের ইসলামবাগ ও আশপাশের এলাকাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন ও ছোট-বড় কারখানা। এক ভবন থেকে আরেক ভবনের দূরত্ব অতি কম ও গলিগুলো এতটাই সরু যে, যানবাহন চলাচল প্রায় অসম্ভব। তার অভিযোগ, অধিকাংশ ভবনই রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। এতে অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের মতো দুর্ঘটনা ঘটলে বড় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা। যেগুলোর বর্জ্য সরাসরি নালা-ড্রেনে ফেলে দেওয়ায় পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, একদিকে দূষণ, অন্যদিকে অনিয়ম আর তারের জট সব মিলিয়ে এলাকাবাসী প্রতিদিন আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছে।
ডিএসসিসি প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এলাকাগুলোর ড্রেন পরিষ্কার রাখা, পানিপ্রবাহ সচল রাখা ও বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব আমাদের। এসব বিষয়ে যদি কোনো অভিযোগ পাই, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সিটি করপোরেশনের কর্মী পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, এলাকাবাসী যদি লিখিতভাবে অভিযোগ দেয় তাহলে সেগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ-সংক্রান্ত সমস্যার জন্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দ্রুত সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নাগরিকদের অভিযোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। যদি এলাকাবাসী সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় এবং সমস্যাগুলো জানায়, ধাপে ধাপে পুরো এলাকাকে বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদে পরিণত করতে আমরা কাজ করে যাব।

