ইতিহাস/ঐতিহ্য
ইতিহাসের ধ্রুবতারা তারা মসজিদ
নজরদারির অভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে * বিদ্যুৎ বিল অনাদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন দুইবার
যুগান্তার প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কালের সাক্ষী হিসাবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক তারা বা সিতারা মসজিদ। নির্মাণের নির্ধারিত দিন-তারিখ জানা না থাকলেও এ মসজিদের রয়েছে গৌরবগাথা ইতিহাস, যা বিশ্বের দরবারে সর্বাধিক সমাদৃত। এটি ওয়াকফ আহমেদ মির্জা ওয়াকফ স্টেট (ইসি নম্বর ১৩৯৬)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সরকারি এ মসজিদের ৩৯ বছরে ২২ লক্ষাধিক টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এদিকে সরকারি ঘোষণার পরও বিদ্যুৎ বিল অনাদায়ের দায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নের নোটিশ বারবার দেওয়া হচ্ছে কমিটিকে। এরই মধ্যে দুবার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পরে এলাকাবাসীর আবেদনে পুনঃসংযোগ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগ। রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায়, মসজিদটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বলে শঙ্কিত এলাকাবাসী।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খায়রাত সড়কের পাশেই অবস্থিত এ তারা মসজিদ। চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য যার নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হতে হয় দর্শনার্থীদের। যে কোনো পথিক হঠাৎ মসজিদের কারুকাজ দেখলে থমকে দাঁড়ান। আর ভেতরের অপরূপ কারুকাজ, নিপুণ হাতের শিল্পকর্ম দেখে আজও পর্যটকরা বিস্মিত হন। মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার এ তারা মসজিদ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় প্রতিদিন দর্শনার্থী ও বিদেশি পর্যটকরা আসেন দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৩ শতাধিক বছর আগে ১৭১১ খ্রিষ্টাব্দের কোনো একসময় ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পির ওরফে মির্জা আহমদ জান তারা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় ১৮ শতকে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলেও মতামত রয়েছে। তবে এ স্থাপনাটিকে মির্জা গোলাম পিরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ বলেও অভিহিত করা হয়। ধারণা করা হয়, ১৭ শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোগল স্থাপত্যশৈলী অনুসরণে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রবীণ এলাকাবাসী ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, তারা মসজিদটির প্রথম পরিমাপ ছিল দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) ও প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। প্রথমে ৩টি গম্বুজ ছিল। মাঝের গম্বুজটি অনেক বড় ছিল। সাদা মার্বেল পাথরের গম্বুজের ওপর নীল রঙের তারার নকশা যুক্ত ছিল বলে মসজিদটি তারা মসজিদ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তখন ৩টি প্রবেশপথের সঙ্গে সংগতি রেখে অভ্যন্তরে ছিল ৩টি মিহরাব। তবে কেন্দ্রীয় মিহরাব দুপাশের মিহরাব থেকে বড় ছিল। যেমনটা বড় ছিল মসজিদের মাঝের কেন্দ্রীয় গম্বুজটিও।
এদিকে মসজিদটি তৈরির পর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মির্জা গোলাম পির মারা যায়। পরে ১৯২৬ সালে এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারি তার ব্যক্তিগত অনেক টাকা খরচ করে চীন-জাপানসহ কয়েকটি দেশ থেকে টাইলস ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি নিয়ে এসে মসজিদটি সংস্কার করেন। এ সময় মূল মসজিদকে সংযুক্ত করে পূর্বদিকে বারান্দা করে সম্প্রসারণ করা হয়। এতে প্রস্থে ৩.৯৯ মিটার সম্প্রসারিত হওয়ায় তারা মসজিদের প্রস্থ দাঁড়ায় ৭.৯৮ মিটার। এ সম্প্রসারণে মসজিদের মূল ভূমি নকশায় কোনোরূপ পরিবর্তন না হলেও হরেক রঙিন চকচকে টালির সংযোজন করা হয়। ১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে ছাত্রজীবন থেকে তারা মসজিদে যোগদান করা সবচেয়ে প্রবীণ কর্মকর্তা মুয়াজ্জিন ও সহকারী ইমাম মো. তোফাজ্জল হুসাইন যুগান্তরকে জানান, ১৯৮৫ সালে তারা মসজিদের সাবেক সভাপতি তৎকালীন সংসদ-সদস্য ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র মরহুম জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণের জন্য সরকারের শরণাপন্ন হন। এ লক্ষ্যে ওই বছর ৮ মার্চ মসজিদের দৈন্যদশা দূর করতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তারা মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণ কাজের উদ্বোধন করেন। পরে ১৯৮৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সব কাজ শেষে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ তারা মসজিদের সরকারীকরণের উদ্বোধন করেন। মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণ কার্যকালে ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজের মসজিদকে পাঁচ গম্বুজের মসজিদে রূপান্তর করা হয়। এতে মসজিদটি দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু প্রস্থে কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। বর্তমানে সম্প্রসারিত মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)। এছাড়া মসজিদের দেওয়াল ফুল, চাঁদ, তারা, আরবি ক্যালিওগ্রাফিক লিপি ইত্যাদি দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
