Logo
Logo
×

রাজধানীর খবর

ওয়ার্ড পরিক্রমা (উত্তর সিটি) ৫ নম্বর ওয়ার্ড

সড়কে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড

সামান্য বৃষ্টিতেই ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা * অধিকাংশ ফুটপাত হকার ও বাড়ির মালিকদের দখলে

Icon

আফজাল হোসেন, মিরপুর (ঢাকা)

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কালশীর অবৈধ স্ট্যান্ডটি যেন গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। অবৈধ এ স্ট্যান্ডের কারণে ওয়ার্ডের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে তীব্র যানজট থাকে। অনেক সময় কুড়িল ফ্লাইওভার হয়ে ইউসিবি চত্বর দিয়ে আসা উত্তরা, বাড্ডা, গুলশানগামী যানবাহন কালশী মোড়ে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকে। সাংবাদিক আবাসিক এলাকার খালটি সঠিক নজরদারির অভাবে দখল ও দূষণের কবলে পড়েছে। খালে নেই পানির সঠিক প্রবাহ। এক সময় খালটি বাসিন্দাদের কাছে আশীর্বাদ মনে হলেও বর্তমানে ময়লা-আবর্জনা ও বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনার কারণে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই ওয়ার্ডের পুরো এলাকা জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকে। স্থানীয়রা নির্বিচারে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় খালের পানি দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ফুটপাত হকার ও বাড়ির মালিকদের দখলে থাকায় ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি সরকারি জমিদখল করে বেশ কয়েকটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। এসব গ্যারেজে কয়েক হাজার অটোরিকশার অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ টেনে চার্জ দেওয়া হয়। এতে সরকারের প্রতি মাসে গচ্চা যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় তিনটি পুকুর দখল করেছে প্রভাবশালীরা। পুকুরের পাড় দখল করে অবৈধভাবে অটোরিকশার গ্যারেজ, ফলের আড়ত ও বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পলাশনগর এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। বছরের পর বছর পার হলেও সড়কগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ ওয়ার্ডে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাদক বিক্রি করেন। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই খুনের ঘটনা ঘটে।

ওয়ার্ডটিতে অটোরিকশার অবাধ যাতায়াত, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ, ওয়াসার পানির সংকট, জুয়া, খাল-বিল দখল করে প্লট বাণিজ্য, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি, মশা-মাছির উপদ্রব, আবাসিক এলাকায় অবৈধ কারখানা, কিশোর গ্যাং, সন্ত্রাস ও মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।

ওয়ার্ড পরিচিতি : মিরপুরের সেকশন-১১, কালশী, সেকশন-১১ এর ব্লক-এ, ব্লক-বি, ব্লক-ডি, ব্লক-ই, আদর্শনগর ডুইপ, পলাশীনগর ডুইপ, বাউনিয়া বেড়িবাঁধ, বাইশটেকী (আংশিক), লালমাটিয়া, সাংবাদিক আবাসিক এলাকা, পলাশনগর ও ব্লক-সির বাউনিয়াবাঁধের আংশিক নিয়ে এ ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে হোল্ডিং সংখ্যা ২ হাজার ১৯০টি। ৮৩ হাজার ৯৪৩ জন ভোটারের এ ওয়ার্ডে বসবাস করছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। ওয়ার্ডটি সংসদীয় ঢাকা-১৬ আসনভুক্ত ও ডিএনসিসির অঞ্চল-২ আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধিভুক্ত।

সরেজমিন দেখা গেছে, লালমাটিয়া টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে উত্তর দিকে কালশী সড়ক পর্যন্ত সারি সারি পিকআপ, কাভারভ্যান, লেগুনা, ট্রাক থামিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে কয়েকশ যানবাহন রয়েছে। প্রতিনিয়ত স্ট্যান্ডে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। কালশী মূল সড়কে গিয়েও যানবাহন পার্কিং করে রাখা হয়। এতে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ১২০ ফিটের সড়কটির বামপাশের লেন পুরোপুরি স্ট্যান্ডের দখলে চলে গেছে। পলাশনগর ও বাইশটেকী এলাকার খালটি পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। এতে সামান্য বৃষ্টি হলে পলাশনগর, আদর্শনগর, কালশী, বাউনিয়াবাঁধ, সাংবাদিক আবাসিক এলাকা, ব্লক-ডি ও এর আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত জমে থাকা পানি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরেও নামতে চায় না। অনেক সময় খালের ময়লা পানি গিয়ে ওঠে বাসাবাড়িতে। কালশী ২২ তলার পাশের খালে জমে থাকা পানি কোনোদিকে সরতে না পারায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় এ ব্লক হিন্দুপাড়া থেকে ডি ব্লক পর্যন্ত ড্রেনের ওপর দোকানপাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সামান্য বৃষ্টি হলে ওই এলাকায় দীর্ঘসময় পানি জমে থাকে। এতে দুর্ভোগে পড়েন হাজারো মানুষ। বাউনিয়াবাঁধের বাসিন্দারা জানান, কিশোর গ্যাং, জুয়া ও মাদকের ভয়াবহ বিস্তারে তারা শঙ্কিত। প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই। তাদের অভিযোগ, মহল্লার আনাচে-কানাচে বিক্রি হয় মাদক। মাদক ও জুয়ার হটস্পট রয়েছে পাঁচটি। বি ব্লক শাহীন স্টার স্কুলের সামনে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাদক পাওয়া যায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাদক বিক্রি করছেন। এমনকি একই পরিবারের মা, বাবা, ভাই, বোন ও আত্মীয়স্বজন প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছেন। এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি গ্রুপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ ওয়ার্ডে বেশ কয়েকটি বিহারি ক্যাম্প ও বস্তি রয়েছে। ক্যাম্পে বসবাসরত বিহারিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্ষার মৌসুমে ভারি বর্ষণে ক্যাম্পগুলো পানিতে ডুবে যায়। তখন ক্যাম্প ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করেন তারা। এছাড়া ক্যাম্পে বৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নেই। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠী। ওয়ার্ড ঘুরে আরও দেখা গেছে, মিরপুর-১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে লালমাটিয়া টেম্পোস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কটির দুপাশ দখল করে অবৈধ স্থাপনা ও কয়েকশ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে। একই চিত্র দেখা গেছে মিরপুর-১১ নম্বর ভাসানী মোড় থেকে মিল্লাত ক্যাম্প ও পূরবী থেকে কালশী সড়কের ফুটপাতে। বাড়ির মালিকরা নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালু, সিমেন্ট এবং রড ফুটপাতে রাখছে। কোথাও কোথাও হকাররা তাদের ভ্যানগাড়ি রাখছে ফুটপাতে। এ ওয়ার্ডে পানির তীব্র সংকট চলছে। মিরপুর-১১ নম্বর এ, বি, সি এবং ডি ব্লকে দিনের বেশির ভাগ সময় ওয়াসার লাইনে পানি থাকে না। ২-১ দিন পর পানি এলেও তা ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত থাকে।

এছাড়া ওয়ার্ডের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ময়লার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের ৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও তাদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো নয়। এলাকায় পাঁচটি ময়লার কনটেইনার থাকলেও সেগুলো সঠিক সময় পরিষ্কার করা হয় না। একটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকলেও আরও দুটি এসটিএসের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান বাসিন্দারা। এছাড়া শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও চিত্তবিনোদনের জন্য নেই কোনো পার্ক ও কমিউনিটি সেন্টার।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আদর্শনগর হাইস্কুলের শিক্ষক সোলেমান বলেন, এলাকায় একটি মাত্র খেলার মাঠ থাকলেও সেটি সংস্কারের অভাবে খেলার পরিবেশ নেই। মাঠে মাদকসেবী ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত থাকায় অনেকে ভয়ে খেলতে যায় না। মাঝে মধ্যে মাঠ দখল করে মেলাও বসে। এলাকায় মশার উপদ্রব ক্রমেই বাড়ছে। সারা বছর মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হন স্থানীয়রা। ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা ও অবৈধ দখলের পাশাপাশি মাদকের সরবরাহ ও বিপণন বেড়েছে। ভয়ানক এ মাদক থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সব খালি জায়গা উচ্ছেদ করে পার্ক ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। বাউনিয়াবাঁধে ২৬০০ প্লট মালিকের প্লট বরাদ্দের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বাড়ির মালিকদের প্লট বরাদ্দের কথা বলে একটি প্রভাবশালী মহল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বরাদ্দপত্র বিতরণ করা জরুরি। তাহলে সেখানে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এখানে সিটি করপোরেশন ও এনজিওর সমন্বয়ে অন্তত ১০-১২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। এছাড়া পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে যেসব এনজিও, সিটি করপোরেশন এবং সরকারি সংস্থা নাগরিক সেবা প্রদান করে, তাদের সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করতে হবে। যেন নাগরিকরা তাদের সেবাপ্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত ওই সেলে আবেদন অথবা অভিযোগ করতে পারেন।

ডিএনসিসি অঞ্চল-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, কারও অভিযোগ থাকলে লিখিতভাবে পেশ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম