ওয়ার্ড পরিক্রমা (উত্তর সিটি): ১৮ নম্বর ওয়ার্ড
সড়ক যেন মরণফাঁদ
ফুটওভার ব্রিজেও অবৈধ দোকান : মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা * ওয়াসার পানি ও গ্যাস সংকট চরমে
মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, ডেমরা ও নাজমুল হক, ভাটারা (ঢাকা)
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের অধিকাংশ সড়ক ও ফুটপাত হকারদের দখলে রয়েছে। এতে ওয়ার্ডের প্রধান সড়কগুলোতে সৃষ্ট যানজটে, যাত্রী-পথচারীরা নাকাল হয়ে পড়েছেন। আর ফুটপাতগুলোতেও ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল। এদিকে ফুটওভারব্রিজের দু’পাশ দখল করেও বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকানপাট। এতে মানুষের চলাচলে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এসব অবৈধ দোকানপাটকে ঘিরে চলছে রাজনৈতিক দলের নেতা ও পুলিশের চাঁদাবাজি।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ওয়ার্ডের সর্বত্রই বেড়েছে কিশোর গ্যাংসহ অপরাধীরা। এতে বেড়েছে মাদকের বিস্তার ও ছিনতাই-রাহাজানি। ওয়ার্ডটিতে অসহনীয় মশার উপদ্রব বাড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই নজরদারি। পাশাপাশি অধিকাংশ এলাকায় ওয়াসার পানি ও গ্যাস সংকট বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এদিকে ওয়ার্ডের অধিকাংশ সড়ক বাতি অকেজো বলে অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকাগুলোতে অবাধে মাদক বিক্রির পাশাপাশি ছিনতাই-রাহাজানির অভিযোগও রয়েছে।
ওয়ার্ড পরিচিতি : ডিএনসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডটি রাজধানীর অভিজাত গুলশান থানার আওতাধীন। বারিধারা আবাসিক এলাকার আই ও কে ব্লক (১৯৮০ সালে প্রকাশিত গেজেট অনুসারে), কালাচাঁদপুর, নদ্দা, শাহজাদপুর (ক, খ ও গ) এলাকা নিয়ে গঠিত। এটি ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ আঞ্চলিক কার্যালয় ও সংসদীয় ঢাকা-১৭ আসনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা। এটি সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছিল। এর আয়তন ১.৭৪ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ডটিতে ভোটার সংখ্যা ৬৮ হাজারের বেশি।
সরেজমিন দেখা গেছে, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যস্ততম সড়কগুলোর দুপাশ দখল করে গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। শুধু সড়ক নয়, এ ওয়ার্ডের পথচারীদের হাঁটার সব ফুটপাতও দখল করে ব্যবসা করছে হকাররা। অভিজাত ও ডিপ্লোমেটিক জোনের এ এলাকার একটি ফুটপাতও খুঁজে পাওয়া যায়নি দখলমুক্ত। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সড়কেও অবৈধ অস্থায়ী দোকানপাটসহ ভ্যানে ভাসমান দোকান বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ওয়ার্ডের নদ্দা থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত প্রগতি স্মরণিখ্যাত প্রধান সড়কটির দু’পাশ দখল করে বসানো হয়েছে অবৈধ দোকানপাট। আর হকারদের দখলে থাকায় সড়কটিতে নিত্য দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। একই চিত্র দেখা গেছে গুলশান লেক থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত প্রধান সড়কের। এতে এ সড়কটিতে ৩-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত যানজট স্থায়ী হয়। নূরের চালা কবরস্থান থেকে বাঁশতলা মূল সড়কের দু’পাশ হকারদের দখলে রয়েছে বলে দীর্ঘ যানজটে নাকাল হয়ে পড়েন যাত্রী-পথচারী।
এ বিষয়ে গুলশান সোসাইটির মহাসচিব সৈয়দ আহসান হাবিব যুগান্তরকে বলেন, ডিএনসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডটি বাংলাদেশের একটি অভিজাত এলাকা। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও বিদেশি ব্যবসায়ীরা চলাফেরা করে। অথচ এ ওয়ার্ডের সর্বত্রই প্রধান সড়ক-ফুটপাত হকারদের দখলে। এখানে বিদেশিরা ফুটপাতে অনেক সময় হাঁটতে বের হলে দখলদারিত্বের ছবি তোলেন। এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বিদেশে। আর ভিআইপি এ এলাকায় এখনো ভিখারি, হিজড়া ও নিষিদ্ধ ইজিবাইক-অটোরিকশা নির্দ্বিধায় বিচরণ করে।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বারিধারা ডিওএইচএস থেকে নদ্দা পর্যন্ত প্রধান সড়কটির দুপাশ দখল করে অবৈধ দোকানপাট বসানো হয়েছে। ওইসব সড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ফুটপাতগুলোও হকারদের দখলে থাকায় মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের একমাত্র ডিপ্লোমেটিক জোন (বারিধারা) এই ওয়ার্ডে। এখানে বিভিন্ন দেশের ডিপ্লোম্যাট, দেশ-বিদেশের অতিথি এবং ইন্টারন্যাশনাল ডোনারদের চলাচল গুলশানে। অথচ গুলশানের সড়কগুলো বর্তমানে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা-ইজিবাইকের দখলে। ভিক্ষুক ও হিজড়াদের দখলে গুলশান ১ ও ২ সার্কেল এলাকা। গুলশানের এক সময়ের সৌন্দর্যের লেকটির পাড়ে আবর্জনা ফেলে রাখা হচ্ছে বলে দুর্গন্ধ ছড়ায় চারদিকে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দুই সপ্তাহ পর গত বছর ১৯ আগস্ট ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণসহ ১২ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করায় হঠাৎ ভেঙে পড়ে ওয়ার্ডের সেবাকার্যক্রম। পরবর্তীতে নির্বাহী অফিসারের অধীনে কাউন্সিলর সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও পরিপূর্ণ সেবার আওতায় আসেনি নাগরিকদের সেবা। এদিকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডটিতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংসহ অপরাধী পথশিশুদের দৌরাত্ম্য ও মাদক বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণহীন দৌরাত্ম্য বেড়েছে এলাকাটিতে। ওয়ার্ডটিতে গ্যাস ও ওয়াসার পানির চরম সংকটের পাশাপাশি মশার চরম উপদ্রব বেড়েছে। যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ, বেওয়ারিশ কুকুর ও মেট্রো রেলের কাজের কারণে সৃষ্ট যানজটে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা।
শাহজাদপুরের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব মঈন যুগান্তরকে বলেন, শাহজাদপুরে এখনো গ্যাস ও বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছে। পাশাপাশি মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে বেড়েছে মাদকের আগ্রাসন। এক্ষেত্রে রাস্তায় আলো থাকলে অবাধে মাদক বেচাকেনায় ঝামেলা হয় বলে মাদক কারবারিরা সড়ক বাতি অকেজো করে অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
স্থায়ী বাসিন্দা ফাহাদ হোসেন ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, ফুটপাতে বিভিন্ন দোকান, ভাসমান ভ্যানগাড়ি, পাবলিক টয়লেট, সড়কে ইটা-বালু-পাথর, ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা, ভিক্ষুকদের আবাসস্থল অথবা বাস কাউন্টার দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে হাঁটার উপায় নেই।
সেবার মান নিয়ে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড সচিব শেখ ইকরামুল কবির যুগান্তরকে বলেন, কাউন্সিলর না থাকায় নাগরিক সেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। কাউন্সিলররা যে কোনো বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন যা সচিবদের অনেক যাচাই-বাছাই করতে হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি সিটি করপোরেশন নির্ধারিত সব সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।
দখলযজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) যুগান্তরকে বলেন, সড়ক-ফুটপাত এগুলো ডিএনসিসির সম্পত্তি বলে প্রশাসন ও ডিএনসিসির যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থেকে প্রশাসন ও ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিলেই অবৈধ দখলযজ্ঞ বন্ধ হবে। আর মাদক নির্মূলে ৩ বা ৫ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
