ইতিহাস/ঐতিহ্য
রামমোহন পাঠাগার শুধু স্মৃতিতে
হাজারীবাগ (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পুরান ঢাকার পথ ধরে হাঁটলে চোখে পড়ে জরাজীর্ণ ভবনের রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার। এটি ঢাকার প্রথম পাঠাগার হিসাবে পরিচিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত এ পাঠাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেটের সামনে দিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পাশ ধরে এগোলে ডান পাশে নজরে আসে এ প্রাচীন স্থাপনা।
প্রথমে পাঠাগারটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে ভবনের দেওয়ালে জন্ম নেয় একটি বিরাট বটগাছ, যা ভবনকে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে পাঠাগারটি বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তর করা হয়েছে। কালের বিবর্তনে এ পাঠাগার অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। এখন পাঠাগারটি প্রায় পরিত্যক্ত; একসময় হাজার হাজার বই থাকলেও আজকের দিনে সেখানে বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এ পাঠাগার একসময় জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র ছিল। জানা যায়, একসময় এখানে ৩০ হাজারেরও বেশি বইয়ের সংগ্রহ ছিল। প্রায় সব ধরনের বইয়ের দেখা মিলত এখানে। বিশেষ করে ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কিত বই। শুরুর দিনগুলোয় শত শত মানুষ ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গনে বই পড়তে ও আলোচনা করতে আসতেন।
একেশ্বরবাদের ওপর নির্ভর করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ। পুরান ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মকর্ম সংস্কারের পাশাপাশি ১৮৭১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অভয় চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের নামানুসারে এ পাঠাগারের নামকরণ করা হয়।
১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসে যে তিনটি দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার একটি ছিল এ পাঠাগার। এছাড়া এখানে সময় কাটিয়েছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল ও কবি শামসুর রাহমান।
ছোট্ট স্থান হলেও এটি ঢাকার শিক্ষাজীবী ও গবেষণার ইতিহাসের অমর সাক্ষী। বইয়ের সংখ্যা কমে গেলেও এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ন রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। মন্দিরের দোতলায় সেই পুরোনো চিকন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর এই ছোট্ট একটা পাঠাগার। আনুমানিক ২০০ স্কয়ার ফুটের এ রুমে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দেওয়ালে টাঙানো বিভিন্ন কবি-লেখক ও বরেণ্য ব্যক্তিদের ছবি। যেমন: সুকান্ত ভট্টাচার্য, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুফিয়া কামাল, শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, পল্লিকবি জসীমউদ্দীন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাঠাগারে ব্রাহ্ম ধর্মীয় গ্রন্থের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্র রচনাবলী রয়েছে। রাজা রামমোহন রায় পাঠাগারের জরাজীর্ণ ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। ২০০৫ সালে তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে রিট করে ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসাবে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০০৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে ভবনটি পুরাকীর্তি আইনের আওতায় পড়ে না বলে জানায়।
বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি যুগান্তরকে বলেন, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত গবেষণার জন্য। পাঠকের জন্য সব সময় উন্মুক্ত থাকলে আশানুরূপ পাঠক পাওয়া যায় না। তবে আদালতে মামলা চলমান থাকায় পাঠাগারটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এ মুহূর্তে মন্তব্য করতে চাই না।
