রাজধানীতে মাদকের ভয়ংকর থাবা
সক্রিয় ৬৫১ কারবারি বিক্রি ২৪৭ হটস্পটে
কারবারি বেশি ডিএমপির মতিঝিল বিভাগে, হটস্পট তেজগাঁও
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মো. জাহাঙ্গীর। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। থাকেন রাজধানীর শাহ আলী থানার ঝিলপাড়ে। এক দশক ধরে শাহ আলীর মাজার ও ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় মাদকের কারবার করছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে শাহ আলী ও রূপনগর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৩টি মামলা রয়েছে। ২০১৭ সালে প্রথম গ্রেফতার হন জাহাঙ্গীর। পরে বহুবার গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে ফের জড়িয়েছেন মাদক কারবারে।
রাজধানীর গেন্ডারিয়া ও কদমতলী থানায় ৬টি মাদক মামলা রয়েছে মোছা. জরিনা বেগমের নামে। তিনি থাকেন কদমতলী থানার শ্যামপুর বড়ইতলা রেললাইনের পাশে। রেললাইন এলাকায় মাদক বিক্রি করেন।
শুধু জাহাঙ্গীর ও জরিনাই নন, রাজধানীজুড়ে অন্তত ৬৫১ মাদক কারবারি সক্রিয় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩১৭ জন ভাসমান। কারবারিরা রাজধানীর ২৪৭টি স্থানকে মাদক বিক্রির হটস্পট হিসাবে গড়ে তুলেছেন। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই এসব স্থানে দেদার বিক্রি হয় গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইনসহ নিত্যনতুন মাদক। এমনকি কোথাও কোথাও ক্রিস্টাল, মেথ বা আইসের মতো ভয়ংকর মাদকদ্রব্যও বিক্রি হচ্ছে। পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের করা তালিকা থেকে পাওয়া গেছে মাদক কারবারি ও হটস্পটের উল্লিখিত তথ্য।
তালিকায় দেখা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের আটটি বিভাগের মধ্যে তেজগাঁওয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৩টি মাদকের হটস্পট রয়েছে। এছাড়া ওয়ারী বিভাগে ৪৯টি, মতিঝিল বিভাগে ৪২টি, লালবাগ বিভাগে ২৬টি, গুলশান বিভাগে ২৬টি, মিরপুর বিভাগে ২৪টি, উত্তরা বিভাগে ১৩টি ও রমনা বিভাগে ৪টি মাদক বেচাকেনার হটস্পট রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি মাদক কারবারির অবস্থান মতিঝিল বিভাগে। এখানে সাতটি থানা এলাকায় ১৮৫ মাদক কারবারির বাস। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তেজগাঁও। এ বিভাগের ছয়টি থানা এলাকায় ১৪৮ মাদক কারবারি রয়েছে। এছাড়া রমনায় ৭৩, ওয়ারীতে ৬৭, মিরপুরে ৬১, গুলশানে ৪৩, লালবাগে ৪৩ এবং উত্তরায় ৩১ কারবারির অবস্থান।
এদিকে মাদক বিক্রির হটস্পট ও কারবারি শনাক্ত হলেও মাদকের লাগাম টানতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) তাদের ৫০টি থানা এলাকায় লাগাতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। তবুও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মাদক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। মাদক কারবারিদের একাধিক তালিকা ধরে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদরদপ্তর প্রকাশিত অপরাধের মামলার পরিসংখ্যান সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০টি থানায় ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে ৬৭ হাজার ৭২৪টি। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৩ হাজার ৬৬১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি লাখের ওপরে। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি রাজধানীর মাদকের বিস্তার। পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকসহ গ্রেফতারের পর আসামিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ সামছুদ্দোহা সুমন যুগান্তরকে বলেন, মামলার ত্রুটিপূর্ণ এজাহার, আটকের পর আগের কোনো মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ নানা কারণে মাদক মামলা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে আইনের ফাঁক দিয়ে সহজেই জামিন পায় আসামিরা।
শাহআলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম আজম যুগান্তরকে বলেন, এই থানা এলাকায় মাদক সেবনকারী বেশি। বিশেষ করে মাজার এলাকায়। বেশির ভাগ মাদক কারবারি পল্লবী এলাকায় বাস করেন আর শাহআলী থানা এলাকায় এসে মাদক বিক্রি করেন। আমরা প্রতিদিনই গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাতটি থানার ২৪টি মাদক হটস্পটে ৬১ জন কারবারি সক্রিয়। স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম কাফরুল থানার কাঁঠাল মাঠ। সেখানে মাদক কারবারিদের অন্যতম মেহেদী হাসান তানভীর। তার বিরুদ্ধে চারটি মাদক মামলা রয়েছে, গ্রেফতারও হয়েছেন একাধিকবার। পল্লবী থানার থার্টি হার্স ক্যাম্প এলাকার মাদক কারবারি মো. মফিজ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে মাদকের ১২ মামলা। পল্লবী থানার মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় মোসা. আনোয়ারী ও মহিউদ্দিন জীবন, আদর্শনগরে ফাতেমা বেগম, কুর্মিটোলা ক্যাম্পে শাহজাদি মাদক কারবারিতে যুক্ত রয়েছেন।
যাত্রাবাড়ীর সায়েদাবাদ ওয়াসা এলাকায় সক্রিয় কারবারিদের মধ্যে রয়েছেন রমজান আলী, মোহাম্মদআলী, বাবু, সাজুসহ ১২ জন। সুতি খালপাড়ে শুকতারা, ফিরুজা ও চোর সাদ্দাম মাদক বিক্রি করেন।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগে সক্রিয় ১৮৫ কারবারির মধ্যে ১২৬ জনই ভাসমান। তারা বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিক্রি করে থাকেন। অনেক সময় মতিঝিল এলাকার বাইরেও তারা মাদক ডেলিবারি দিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন-ভুট্টো, ইমরান হোসেন ওরফে রায়হান, শাহীন ওরফে স্বাধীন, জাকির, তানিয়া, ওমর ফারুক ও মোখলেছুর রহমান।

