হজ ফ্লাইট নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা
উড়োজাহাজ সংকটে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান
একাধিক আন্তর্জাতিক রুট বন্ধ * নতুন উড়োজাহাজ ক্রয় প্রস্তাব যাচাই চলছে, পাওয়া যাবে ২০৩২ সালে * পাঁচ বছরে নতুন কোনো উড়োজাহাজ যোগ হয়নি বিমানে * ‘ওয়েট লিজে’ খরচ বাড়বে -এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
উড়োজাহাজ সংকটের তীব্রতায় জর্জরিত রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গত পাঁচ বছরে বহরে যুক্ত হয়নি নতুন কোনো এয়ারক্রাফট। বন্ধ হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক রুট। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যে ফ্লাইট বাড়াতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। লিজ (ভাড়া) করা দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ ফেরত যাচ্ছে ডিসেম্বরে। দফায় দফায় দরপত্র আহ্বান করেও মিলছে না সাড়া। ফলে নতুন বিমান যুক্ত না হলে স্বাভাবিক ফ্লাইট চলাচল ও আসন্ন হজ ফ্লাইট পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন উড়োজাহাজ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনায় সক্ষম হবে না। বিশেষ করে হজের মৌসুমে এ সংকট আরও দৃশ্যমান হবে। এ মুহূর্তে অবিলম্বে বহরে নতুন বিমান যুক্ত করা জরুরি। নইলে দেশের আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।
সূত্রমতে, এয়ারক্রাফট সংকটে এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা-ম্যানচেস্টার ফ্লাইট স্থগিত করা হয়। এরপর ১ জুলাই থেকে ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয় বিমান। কয়েক বছর ধরেই বহর সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে সংস্থাটি। নতুন উড়োজাহাজ কেনার জন্য এয়ারবাস (ফ্রান্স) ও বোয়িং (যুক্তরাষ্ট্র) কোম্পানির প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের সময় এয়ারবাস ১০টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছিল প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা স্থগিত হয়। পরবর্তী সময়ে বোয়িংও নতুন প্রস্তাব পাঠায় এবং গত জুলাইয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা জানায়।
নতুন উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগে এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের প্রস্তাব বর্তমানে যাচাই-বাছাই করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি শেষে নতুন উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হতে কমপক্ষে সাত বছর সময় লাগবে।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জানান, উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দ্রুত চুক্তি হলেও ২০৩২ সালের আগে তারা উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে না।
তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিমানের বহরে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ ও পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। এগুলো দিয়ে বিমান ২৩টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ভাড়ার মেয়াদ শেষে বহরের দুটি বোয়িং ডিসেম্বরে ফেরত যাচ্ছে। এ দুটি ফেরত গেলে বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা হবে ১৯টি। ২০২০ সালে সর্বশেষ মিসর থেকে দুটি উড়োজাহাজ ড্রাই লিজে নেওয়া হয়েছিল, যা নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আগের অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। উড়োজাহাজ সংকটের কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ শুরুতে লিজের উড়োজাহাজ দুটি কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত অজানা কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
বিমানের বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেকদিন ধরেই মার্কেটিং বিভাগের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের লাভজনক জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মামের মতো রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করা হচ্ছিল। কিন্তু বহরে উড়োজাহাজ সংকটের কারণে তা করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।
এদিকে দফায় দফায় দরপত্র দিয়েও উড়োজাহাজ লিজ নিতে ব্যর্থ হয় বিমান। এ বছর হজের সময় উড়োজাহাজ সংকটের কারণে হজযাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়লে জরুরি ভিত্তিতে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮ উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করে বিমান। সিদ্ধান্ত ছিল, ছয় বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া হবে। এর একটি গত ১ ফেব্রুয়ারি এবং অন্যটি ১ এপ্রিলের মধ্যে বহরে যুক্ত করার কথা ছিল। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চার দফায় দরপত্র দিলেও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়া পায়নি বিমান। ফলে গত হজ মৌসুমে বিদ্যমান উড়োজাহাজ দিয়েই ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমানের বর্তমান দরপত্র আহ্বানের পদ্ধতিতে উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে কোনো এয়ারলাইন্সই তাদের উড়োজাহাজ বিমানের জন্য একদিনও অলস বসিয়ে রাখবে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক পাইলট যুগান্তরকে বলেন, একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানে উড়োজাহাজের সংকট দেখা দিয়েছে। এসব ত্রুটির কবলে পড়ে প্রায়ই বিভিন্ন রুটের ফ্লাইট বাতিল হয়। এ অবস্থায় বহরে নতুন উড়োজাহাজ না যুক্ত করলে সংকট সমাধান হবে না।
এদিকে নতুন উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় সংকট কাটাতে বিমানকে ভাড়ায় উড়োজাহাজ আনার ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। যাত্রী পরিবহণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দূরপাল্লার আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় পরিষেবা সচল রাখতে বহরে দুটি ওয়াইড-বডি এয়ারক্রাফট যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিমান। এ লক্ষ্যে ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। দরপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলত সামনের হজ মৌসুমের চাপ সামাল দিতে এ দুটি উড়োজাহাজ আগামী বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৬ দিনের জন্য ভাড়া (ওয়েট লিজে) নিতে চায় বিমান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়েট লিজে এয়ারক্রাফট আনা সব সময়ই ব্যয়বহুল প্রমাণিত হয়েছে। ওয়েট লিজে উড়োজাহাজ ক্রু, মেইনটেন্যান্স এবং ইনসুরেন্সসহ আসে। ফলে খরচ স্থায়ী লিজ বা নিজস্ব বহরের তুলনায় অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি হলেও সংস্থার আর্থিক চাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, যাত্রীর চাহিদা বাড়ছে, ফলে বহর ছোট হয়ে গেলে ফ্লাইট পরিচালনায় সমস্যা হবে। তাই ঘাটতি সামাল দিতে অন্তত কিছু উড়োজাহাজ ওয়েট লিজে আনার চেষ্টা চলছে।

