জরাজীর্ণ ডাকসু ভবন হল সংসদও করুণ
২৯ বছরে ডাকসুর নামে প্রায় ১২ কোটি টাকা আদায় * নির্বাচনের খসড়ার বিষয়ে ছাত্র সংগঠনের মতামত আহ্বান
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে ডাকসু ভবন। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকায় ভিপি-জিএসসহ অন্য কক্ষগুলোর অবস্থাও নাজুক। হল সংসদের করুণ দশা বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ জানেই না এই কক্ষগুলোর কাজ কী। এতদিন ডাকসু না থাকলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয় ডাকসু ও হল সংসদ ফি। এ দুই খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। অথচ ওই অর্থ কোন খাতে কীভাবে ব্যয় হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট হিসাব দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী ১১ মার্চের ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
মধুর ক্যান্টিনের সামনে ডাকসু ভবনে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার সংগ্রহশালা কিছুটা গোছানো থাকলেও দোতলার অবস্থা নাজুক। সেখানে ভিপি, জিএস, এজিএসের কক্ষগুলো তালাবদ্ধ। জিএসের কক্ষটি ব্যবহৃত হচ্ছে পুরনো চেয়ার-টেবিল এবং পুরনো পত্রিকা রাখার জন্য। কমন রুম, সম্পাদকমণ্ডলীর কক্ষসহ অন্য কক্ষগুলোও রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। এ ছাড়া অন্য সম্পাদকদের জন্য বরাদ্দকৃত যে কক্ষগুলো রয়েছে তার চিত্রও এ অবস্থার ব্যতিক্রম নয়। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে ডাকসু ভবনের কক্ষগুলো সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ডাকসু ভবনে ঢোকার মুখেই একটি কক্ষ ব্যবহৃত হচ্ছে ‘ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র গবেষণা কাজে। দীর্ঘদিন ধরে তারা কক্ষটি ব্যবহার করে আসছেন। ২০১৪ সালের ১০ জুন ‘ডিইউ টাইমজ’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) দুটি কক্ষ ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কক্ষ দুটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তখন এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ডাকসু ভবনে কাজ করেছেন এমন একজন কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, ডাকসুর নেতৃত্ব থাকাকালীন এই ভবনটি ছিল সরগরম। শিক্ষার্থীরা এখানে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নেতাদের কাছে আসত। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও কাজ করত ভবনটি। কিন্তু ১৯৯০ সালের সর্বশেষ নির্বাচনের পর ডাকসু ভবনের কক্ষগুলো অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দিলে ভবনটিতে ছাত্রদের আসা-যাওয়া একেবারেই কমে যায়। মাঝে মাঝে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা এসে এখানে বসেন। এ ছাড়া রিডিং রুমে অনেকে পত্রিকা পড়তে আসেন। এর বাইরে কক্ষগুলোর তেমন কোনো কাজ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হল সংসদের কার্যালয়ের অবস্থাও ভালো নয়। জসীমউদ্দীন হলসহ কয়েকটি হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মাঝে মধ্যে এসব অফিস ব্যবহার করেন। পত্রিকা পড়ার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় কয়েকটি কক্ষ। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলসহ কয়েকটি হলের কার্যালয় পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। তবে আগামী হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে এ কার্যালয়গুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ডাকসু ভবনের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। হল সংসদগুলোও প্রস্তুত করা হচ্ছে। সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্নের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব।
২৯ বছরে ডাকসুর নামে ১২ কোটি টাকা আদায় : ১৯৯০ সালে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের পর ২৮ বছরে আর ভোট না হলেও নেয়া হয়েছে ডাকসু ও হল সংসদের ফি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর ভর্তির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডাকসু ও হল সংসদ ফি বাবদ ৬০ টাকা করে মোট ১২০ টাকা দিতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭ হাজার। সেই হিসাবে এক বছরে আদায় হয় প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা। তবে বর্তমান সময়ের চেয়ে অতীতে ছাত্র সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। সেই হিসাবে যদি ২৯ বছরে প্রতিবছর ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীর থেকেও এ ফি নেয়া হয়ে থাকে তাহলে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন কোর্স ও অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের থেকেও ডাকসু ও হল সংসদের ফি নেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে এই পরিমাণ ১২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে ডাকসুর কার্যক্রম না থাকলেও প্রতিবছর ডাকসুর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় খাতে বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ বরাদ্দ রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট ২০১৮-১৯’ অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২১ লাখ এক হাজার টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ২০ লাখ ৮ হাজার টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। বিগত ২৮ বছরে গড়ে কমিয়ে ধরলেও খরচের পরিমাণ দুই কোটি টাকার মতো হয়। নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও এই খরচ কেন- এমন প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস মোল্লা বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট সব সময়ই ঘাটতি বাজেট। ঘাটতির কারণে বাজেটের ভেতরেই এ টাকা ঢুকে যায়। আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে টাকা (ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ ১২০) নেয়া হয় তা মূলত বেতন খাতের ভেতরেই নেয়া হয়। আর যেহেতু ঘাটতি বাজেট, তাই এ টাকা কোথায় খরচ হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন বলেন, ডাকসু না থাকলেও এসব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ও হল পর্যায়ে নানা খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়। ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী এসব অর্থ খরচ হবে। নিয়মের বাইরে কিছু হবে না।
নির্বাচনের খসড়ার বিষয়ে ছাত্র সংগঠনের মতামত আহ্বান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধির একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোকে আচরণবিধির ওই খসড়া দিয়ে এ ব্যাপারে আজ শনিবারের মধ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছে প্রশাসন। চলতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আচরণবিধির খসড়া পত্রের সঙ্গে প্রেরণ করা হলো। খসড়াটি সম্পর্কে কোনো মতামত বা সুপারিশ থাকলে তা আগামী ২৬ জানুয়ারি শনিবারের মধ্যে প্রক্টর কার্যালয়ে জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
