ঈদ ঘিরে চট্টগ্রামে মোবাইল চোরচক্র বেপরোয়া
দুর্গম এলাকায় আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের মেশিন
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঈদবাজারকে সামনে রেখে চট্টগ্রামে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন চুরির সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্র। চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন কোম্পানিতে কর্মরত প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন লোকজনও জড়িত রয়েছে। গত এক সপ্তাহে ২ শতাধিক চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে একসঙ্গে ১১৭টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। চোরাই মোবাইল ফোনে সয়লাব হয়ে গেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মোবাইল মার্কেট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মোবাইল ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি (আইএমইআই) নম্বর পরিবর্তনের যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শহরে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হলে দ্রুত ধরা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই মোবাইল ফোন চুরির সঙ্গে জড়িত চক্রটি অত্যাধুনিক ওই যন্ত্র ব্যবহারের স্থান হিসাবে শহরের পরিবর্তে দুর্গম এলাকা বেছে নিয়েছে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে চোরাই মোবাইল ফোনে মার্কেট সয়লাব। নগরীর জলসা মার্কেট, সিডিএ মার্কেট, শাহ আমানত মার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় চলছে চোরাই মোবাইল ফোনের জমজমাট ব্যবসা। এই ব্যবসায় জড়িত রয়েছে দশটির বেশি গ্রুপ। তারা পুরো চট্টগ্রামের চোরাই মোবাইল ফোনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। শুধু চট্টগ্রামের নয়; সারা দেশ থেকে আসা চোরাই মোবাইল ফোন এসব মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। চক্রের সদস্যরা চোরাই মোবাইল ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি-আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরবর্তী সময়ে আর চোরাই মোবাইল ফোন শনাক্ত করতে পারে না। এছাড়া একই আইএমইআই নম্বর বসিয়ে একাধিক মোবাইল ফোন সেটও বিক্রি করছে চোরচক্র।
সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা পর মোবাইল চোরচক্র নগরীতে কোথাও টিকতে পারছে না। বিভিন্ন সময় চক্রের সদস্যরা ধরা পড়ছে। এ কারণে উপজেলা বা প্রত্যন্ত এলাকায় তারা আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের যন্ত্র বসিয়ে অপকর্ম করছে। জেলার সাতকানিয়ার কেরানীহাট, লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ও চকরিয়ায়ও একাধিক আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনকারী মেশিন বসিয়েছে চোরচক্র।
সূত্র জানায়, জলসা মার্কেট, সিডিএ মার্কেট, শাহ আমানত মার্কেটে সক্রিয় থাকা একাধিক চক্রের হাতে রয়েছে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের মেশিন। চুরির সঙ্গে জড়িতরা মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের কাছে গেলে ৫০০ টাকা থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে দেয়। আবার দামি আইফোন ও অন্যান্য দামি মোবাইল ফোন হলে নম্বর পরিবর্তনে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান জোরদার হলে চক্রটি নিজেদের আড়াল করতে চলে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে যন্ত্র বা মেশিন বসিয়ে চোরাই মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করছে। আর এ ধরনের মোবাইল তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। অনেকে না বুঝে চোরাই মোবাইল ফোন কিনে পরে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে চুরি ও ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনও চলে আসে নগরীর মোবাইল ফোন চোরচক্রের হাতে।
বুধবার মোবাইল ফোনের আইএমইআই পরিবর্তনকারী একটি চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১১৭টি চোরাই মোবাইল। সাজ্জাদ, হাবীবুল্লাহ মিজবাহ (২৫) ও রাশেদ (২০) নামের এই তিনজনের মধ্যে হাবিবুল্লাহ মিজবাহ ভিভো কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তবে পরে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন চোরাই মোবাইল চোর চক্রের সঙ্গে। আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনে তার রয়েছে নিপুণ দক্ষতা। এ ধরনের সফটওয়্যার ইনস্টল করা তিনটি ল্যাপটপও ওই চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
সিডিএ রয়েল প্লাজার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, নগরী ও আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ছিনতাই হওয়া পণ্য জমা হয় চোরাই মার্কেটে। এখানকার ব্যবসায়ীরা অনেক কম দামে এসব পণ্য অপরাধীদের কাছ থেকে কিনে আবার বিক্রি করে দেন। দোকানগুলো সারা দিন খোলা থাকলেও দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর জমে উঠতে শুরু করে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় থাকে। চোরাই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার চোর, পকেটমার, ছিনতাইকারীদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ থাকে। মাঝেমধ্যে তারা অগ্রিমও দেন। এরপর চাহিদামতো মোবাইল চুরি বা ছিনতাই শেষে ফোন করে নির্দিষ্ট দোকানিকে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে স্টেশন রোড এলাকায় মোবাইল ফোন সেট ডেলিভারি না দিয়ে আশপাশের এলাকায় দেওয়া হয়।
ভারতে চুরি-ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা মোবাইল ফোন সেটও সীমান্ত দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত হয়েছে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই কিংবা অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া এসব মোবাইল সেট পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। চুরি-ছিনতাইয়ের মোবাইল সে দেশে বিক্রি হলে অনেক সময় প্রযুক্তির সহায়তায় আসামি ধরা পড়া বা আলামত হিসাবে উদ্ধারের সম্ভাবনা থাকে। সেগুলো যদি সীমান্ত পার করে দেওয়া যায়, তাহলে আর সমস্যা থাকে না।
সিএমপির ডিসি (দক্ষিণ) জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, চোরাই মোবাইল ফোন চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কোনো অবস্থায় চোরাই মোবাইল ফোন বাজারে আসতে দেওয়া যাবে না। চোরাই মোবাইল ফোন চোরচক্রের মূলহোতাদের আইনের আওতায় আনা চেষ্টা চলছে। চক্রটি নগরীর বাইরে যন্ত্র বসিয়ে মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করছে। এরপর মোবাইল ফোন বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে মোবাইল ফোনের মালিক তার মোবাইলটি শনাক্ত করতে পারছেন না। আবার নম্বর পরিবর্তন করতে না পারলেও চোরাই মোবাইল ৫-৬ মাস বন্ধ করে নিজেদের হেফাজতে রাখে চক্রটি। ততদিনে মালিক তার মোবাইল ফোনের আশা ছেড়ে দেন। আর তখনই চোরাই মোবাইল বাইরে বিক্রি করা হয়।
