Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

৫৩ বছরেও হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা

কখনো কি আলোর মুখ দেখবে

Icon

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কখনো কি আলোর মুখ দেখবে

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সম্পন্ন হয়নি জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের কাজ। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি তালিকা হয়েছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর একের পর এক সংশোধন হয়েছে এ তালিকা। সর্বশেষ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কখনো এ তালিকা আলোর মুখ দেখবে কিনা-ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের যাচাই-বাছাই যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর শুনানি হবে না। আপিল শুনানিও বন্ধ করে দিয়েছি। মামলা বা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধের কারণে যেসব উপজেলায় যাচাই-বাছাই শেষ হয়নি সে বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করার। যতটুকু হয়েছে বাকিদের বিষয়ে পরবর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০১৩-১৪ সালে দেশের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাহিরে থেকে গেছে কিনা-তা নিশ্চিত করতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। তখন বাদপড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদন আহ্বান করা হয়। ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর আবেদন গ্রহণ করা হয়। ওই সময় করা আবেদনগুলো ক-খ-ও গ তালিকা নাম দিয়ে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি যাচাই-বাছাই কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে বিধান করা হয়, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আবেদনকারীকে শনাক্ত করবেন। যদি সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এই মর্মে সাক্ষ্য দেন যে, আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে তার আবেদন ক-তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশে জামুকা বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। জামুকার সুপারিশসহ মন্ত্রণালয় গেলে তা গেজেট প্রকাশ করা হয়।

এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের যাচাই-বাছাইয়ে যদি ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষ্য দেন আবেদনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবার ৪ জন যদি সাক্ষ্য দেন আবেদনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা নন, তাহলে সে আবেদনটি খ-তালিকাভুক্ত করা হয়। এই তালিকার আবেদনকারী জামুকায় আপিল করেন। আর কারও আবেদনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা যদি বলেন তিনি অ-মুক্তিযোদ্ধা, তাহলে তার আবেদন গ-তালিকাভুক্ত করা হয় এবং তিনি জামুকায় আপিল করেন।

জানতে চাইলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চূড়ান্তকরণের কাজ প্রায় শেষ। তবে কিছু কিছু জেলায় এখনো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। জামুকা এখন আপিল শুনানি করছে। জামুকার সুপারিশের পরও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কেন বাদ যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির একজন সহকারী পরিচালক বলেন, অনেক সময় কাগজপত্রে ত্রুটি থাকে। তথ্যর অভাবে যাদের নামে গেজেট হয় না-এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাই এবং তখন তাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়।

জানা গেছে, জামুকা দেশের ৮ বিভাগের জন্য আটজন খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাকে প্রধান করে আটটি কমিটি গঠন করে ২০১৯ সাল থেকে তালিকাভুক্তির জন্য করা মুক্তিযোদ্ধাদের আপিল শুনানি করছেন। শুনানিতে তারা জানতে বা দেখতে চান, কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কত দিন ট্রেনিং করেছেন। কী কী অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছেন। যুদ্ধে কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কোথায় ট্রেনিং নিয়েছেন। সামরিক না বেসামরিক ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছেন। কমান্ডারের নাম কী। কোথায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হয়েছিল। সহযোদ্ধা হিসাবে কেউ আহত কিংবা নিহত হয়েছেন কিনা। জীবিতদের মধ্যে কেউ বেঁচে আছেন কিনা? জীবিত সহযোদ্ধাদের তারা চেনেন কিনা। এছাড়া জম্ম তারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে সনদপত্র এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যেসব কাগজপত্র রয়েছে তা যাচাই করা হয়।

নির্বাচনের কারণে আপিল শুনানি বন্ধ থাকলেও সোমবার জামুকায় গিয়ে দেখা গেছে বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঘোরাঘুরি করছেন। তাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ। তার বাড়ি চাঁদপুর উত্তর থানা। কি সমস্যা নিয়ে এসেছেন জানতে চাইলে বশির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তার ভাই সিপাহি মো. আবুল বাশার ইপিআরে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম হালিশহর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাড়িতে আসেন। বাড়িতে এসে আবুল বাশার চেঙ্গার চরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার সহযোদ্ধা হিসাবে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম, এমএ ওয়াদুদ এবং আব্দুল লতিফ বাগ। এরপর সে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র জমা দেন। এরপর মো. আবুল বাশার সৌদি আরবে চলে যান এবং কয়েক বছর পর মারা যান। কিন্তু তার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পায়নি। সব কাগজপত্র থাকার পরও তিনি বছরের পর বছর ঘুরছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমদের অভিযোগ, জামুকার কর্মচারীরা টাকা চান। অনেক টাকা।

চাঁদপুরের মতলব উপজেলার নূরনবী খলিফা যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. আব্দুল লতিফের সঙ্গে থেকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সৌদি আরব যান এবং ২০ বছর পর দেশে ফেরেন। ইতোমধ্যে ডা. আব্দুল লতিফও ইন্তেকাল করেন। উপজেলা থেকে তার আবেদন যাচাই-বাছাই হয়ে এসেছে কিন্তু গত কয়েক বছর তার নামে গেজেট প্রকাশ হয়নি। তার অভিযোগ জামুকার কর্মচারীরা টাকা চান।

পাবনার সাথিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তার নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। তিনিও অভিযোগ করে বলেন, এখানে কর্মচারীরা টাকা চান। অপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা পাওয়ার একপর্যায়ে ২০১৫ সালে হঠাৎ ৪৬ জনের ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা হাইকোর্টে মামলা করি এবং সবশেষ ২৩ জুন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ আমাদের পক্ষে রায় দিয়ে ২০১৫ সাল থেকে এরিয়ারসহ ভাতা প্রদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু গত ৬ মাসেও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর হয়নি। জামুকা শুধু ঘোরাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল সিস্টেমে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। কিন্তু ভাতা বিতরণ করতে গিয়ে দেখা গেছে প্রায় ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তথ্য সঠিক নয়। অর্থাৎ তাদের এনআইডি, মোবাইল, জম্ম তারিখ ইত্যাদির কোনো মিল নেই। ফলে তাদের তথ্য ডিজিটাইজড করা সম্ভব হয়নি। অথচ তারা বছরের পর বছর সম্মানি ভাতা নিচ্ছেন। এমন ঘটনায় নড়েচড়ে বসে মন্ত্রণালয়। ফের যাচাই-বাছাইয়ের কাজে হাত দেয় মন্ত্রণালয়। যা এখনো চলমান এবং কবে শেষ হবে তা পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না কেউ।

জানতে চাইলে লেখক, শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য শহিদ হতে যুদ্ধে গেছেন, তারা সুবিধা নিতে বা পেতে যুদ্ধে যাননি। যখন তাদের সুবিধা দেওয়া শুরু হলো তখন সেখানে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের বিষয়টি রাজনৈতিক ও স্বার্থের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সব সময় বলে এসছি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পৃথিবীর কোথাও হয়নি। ভারত বা ফ্রান্সের স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের কি তালিকা হয়েছে? না হয়নি তো। আমাদের দেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকায় তারা এ কাজগুলো করেছে। এখনি এ তালিকা তৈরির কাজ বন্ধ করতে হবে। এই ইতিহাসবিদ আরও বলেন, এমন উদাহরণ কি কেউ দেখাতে পারবেন যে একটি তালিকা তৈরির জন্য ছয়বার উদ্যোগ নেওয়া দরকার হয়েছে। যিনি মুক্তিযোদ্ধা তিনি বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। আবার যিনি মুক্তিযোদ্ধা নন তিনি কম সুবিধা পাবেন এগুলো ঠিক নয়। তাহলে শহিদ পরিবারগুলোর কি হবে। বুদ্ধিজীবীদের পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গেল, তাদের কি হবে। যারা ভারত গিয়েছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা আর যারা দেশের ভেতরে থেকে কাজ করেছে তারা মুক্তিযোদ্ধা নন-এটা হয় নাকি? দেশের বাহিরে যারা পাকিস্তান সরকারের কর্মে নিয়োজিত ছিলেন তারা ১৯৭১ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ঘোষণা দিয়েছেন তারা পাকিস্তান সরকারে পক্ষ ত্যাগ করেছেন। এখন দেখি তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এটা কি করে হয়?

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে সম্মানি ভাতা দিচ্ছে সরকার। এছাড়া ঈদ উপলক্ষ্যে ১০ হাজার করে দুটি বোনাস, বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন তারা। খেতাবপ্রাপ্ত, শহিদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ১০ হাজার ৯৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন ৭ জন। বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ৬৯ জন, বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ১৭৫ জন এবং বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ৪২৬ জন। ৫১৯ জন বীরাঙ্গনা, ১৭ প্রবাসী সংগঠক, ২৯৬ শব্দসৈনিকসহ বিভিন্ন বাহিনীর বেসামরিক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ২০২১ সালে খেতাব বাতিল হয়েছে চারজনের। তারা হলেন-লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (বীরউত্তম), একই পদবির এসএইচএম নূর চৌধুরী (বীরবিক্রম), একই পদবির এএইচএম রাশেদ চৌধুরী (বীরপ্রতীক) এবং নায়েক সুবেদার উদ্দিন খান (বীরপ্রতীক)।

শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধা আলো দেখবে

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম