কুমিল্লার ৪টি আসনে নৌকার পরাজয় যে কারণে
এলাকার উন্নয়ন ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করা, স্বজনপ্রীতি, দলাদলি
তাবারক উল্লাহ কায়েস, কুমিল্লা
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লার চারটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয় নিয়ে জেলাজুড়ে এখনো চলছে নানা আলোচনা। বিশেষ করে নিজেরা এমপি থাকাকালেও কেন এমনটি হলো, এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এলাকার উন্নয়নে তেমন ভূমিকা না রাখা, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করে আলাদা বলয় তৈরি করা, স্বজনপ্রীতি ও এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত না করাসহ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত ছিলেন তারা। এতদিন নিপীড়নের ভয়ে অনেকেই মুখ খোলেননি। তাই ব্যালটের মাধ্যমেই এর জবাব দিয়েছেন বলে জানান একাধিক ভোটার।
কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) আসনটি মূলত বিএনপির ঘাঁটি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ারের জীবদ্দশায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত কখনো নৌকা বিজয়ী হয়নি। ২০১৪ সালে ভোট বর্জন করেছে বিএনপি। তবে ২০১৮ সালে এখানে প্রার্থী হন পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা-১ আসনের ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সেসময় তাকে হারিয়ে প্রথমবার নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন নিটোল গ্রুপের ভাইস চেয়ারপারসন সেলিমা আহমাদ মেরী। তিনিও প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। তবে সদ্যসমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল মজিদের কাছে ১ হাজার ৯৬১ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তিনি বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় থাকতেন। একান্ত কোনো প্রয়োজন ছাড়া এলাকায় তার যাতায়াত ছিল না বললেই চলে। তাছাড়াও গত ইউপি নির্বাচনে দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেন। এসব কারণে দলের একটি অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। একসময় হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেহানা বেগমের সঙ্গেও তার বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। অন্যদিকে হোমনা ও মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশও তার ওপর নাখোশ ছিল। তাই তারা বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছিল। কিন্তু এবারও তাকে নৌকার মনোনয়ন দেয় দলীয় হাইকমান্ড। এটি মেনে নেয়নি দলের একটি বড় অংশ। আরেক নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সফিকুল আলম মেঘনা উপজেলায় জনপ্রিয় হলেও হোমনায় ট্রাক প্রতীকের অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ ছিলেন শক্তিশালী। তাই বিক্ষুব্ধ অংশটি তার পক্ষে মাঠে নামে। এছাড়াও সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে তাকে বেছে নেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে একসময়ের জনপ্রিয় পপি লাইব্রেরির কারণেও তিনি ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। নিজে শিক্ষক হওয়ায় তার একসময়ের ছাত্ররাও এবার একাট্টা হয়ে মাঠে নামেন অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের ট্রাকের পক্ষে।
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনটিও বিএনপি অধ্যুষিত। এখানেও ২০০৮ সালের আগে কখনো নৌকার বিজয় হয়নি। আসনটির নেতা কায়কোবাদের একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন এবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন। তার বিরুদ্ধেও এলাকায় কম যাতায়াতের অভিযোগ রয়েছে। ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে সাধারণ নেতাকর্মীদের কয়েক ধাপ অতিক্রম করতে হতো। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়নে ত্যাগীদের অবমূল্যায়নের কারণে তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন দলের একাংশের নেতাকর্মীরা। এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাঘাটের অবস্থাও একেবারে নাজুক। ইউসুফ হারুনকে ঠেকাতে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ঈগলকে বেছে নেন তারা। এসব কারণে জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ১১ হাজার ৯৫৭ ভোটে পরাজয় ঘটে ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের। মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তানভীর আহমেদ বলেন, প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমপি ইউসুফের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারতেন না। সব সময় বেষ্টিত থাকতেন হাইব্রিডদের দ্বারা।
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সীর সুবাদে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়ে চমক দেখান তিনি। ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়েও জয়ী হন। সিনিয়র নেতাদের কখনো মূল্যায়ন করেননি। তাই তাকে হটাতে একটি শক্তিশালী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ কারণে বিগত ইউপি নির্বাচনগুলোয় নৌকার ভরাডুবি ঘটে। ২১ বছর পর দেবিদ্বার পৌর নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। এসব কারণেও দলের একটি বড় অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দ্বাদশ নির্বাচনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের কাছে ১৫ হাজার ৫৫০ ভোটে পরাজিত হন নৌকার প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। দেবিদ্বার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়নের ফল পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী।
কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন প্রবীণ নেতা অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম খান। সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর মৃত্যুর পর ২০২১ সালের ২৫ জুন উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন তিনি। তবে এবার তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ব্যক্তি হিসাবে অত্যন্ত সজ্জন হলেও অসুস্থতার কারণে তিনি একদিনও প্রচারণায় নামতে পারেননি। এর মধ্যে এ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন তিনজন। দলের নেতাকর্মীরা চারভাগে ভাগ হয়ে চার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। এ কারণে আবুল হাসেম খান তৃতীয় হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী কেটলি প্রতীকের এমএ জাহেরের কাছে ৪৩ হাজার ৪৯৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
