Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

তদন্তেই বছরের পর বছর পার

তেরো পুলিশ হত্যার বিচার ঝুলছে

অধিকাংশ আসামিই জামিনে, কেউ পালিয়ে বিদেশে, তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন, হতাশায় পরিবার

Icon

মাহমুদুল হাসান নয়ন

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তেরো পুলিশ হত্যার বিচার ঝুলছে

হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনার তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। শুরু হয় বিচার। তবে তদন্তে গাফিলতি-ধীরগতি ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াসহ নানা কারণে ঝুলে যায় বিচার প্রক্রিয়া। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রেও পাওয়া গেছে একই চিত্র। গত দুই দশকেরও বেশি সময়ে রাজধানীতে ১৫ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় ১৩ মামলার মাত্র একটির রায় হয়েছে। অন্তত ৮টি মামলার প্রায় সব আসামি জামিনে রয়েছেন। আসামিদের কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন। আলোচিত বংশাল থানার এসআই গৌতম কুমার রায় হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের পর ১৩ বছরে ৪৭ সাক্ষীর মাত্র ১২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্যান্য মামলাগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম। বছরের পর বছর বিচারের অপেক্ষায় থাকা পুলিশ পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে হতাশা। তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের সদস্যদের হত্যার বিচারেই এমন দীর্ঘসূত্রতা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঢাকার আদালতে ২০০৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩টি পুলিশ হত্যার মামলা বিশ্লেষণ করে যুগান্তর। সেখানে দেখা যায়, মামলাগুলোর মধ্যে শুধু হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় গুলশান থানার মামলাটির রায় হয়েছে। একটি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে। তদন্তাধীন রয়েছে দুটি। বাকি নয়টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে সারা দেশে ১৪ জন পুলিশ সদস্য মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাসহ অন্যান্য মামলাগুলোরও প্রায় একই দশা।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার শুরু হয় মূলত মামলার তদন্ত থেকে। পুলিশ সক্রিয় থাকলে অনেকাংশেই দীর্ঘসূত্রতা কমে আসে। পুলিশ হত্যা মামলায়ও যদি ঢিলেমি করে এটা তাদের জন্যই সম্মানহানিকর। পুলিশের প্রতিবেদন জমা দিলে বিচার শুরুর পর সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরি। অনেক সময় শুধু আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণে বিচার পিছিয়ে যায়। এজন্য সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতে থানাগুলোকে উদ্যোগী হয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কখনো কখনো আমরাও সাক্ষীদের আনতে কাজ করি। সবমিলিয়ে এ তৎপরতাগুলো জোরদার করলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, আদালতে আমরা নিখুঁতভাবে প্রতিবেদন দিতে চাই বলে কখনো একটু সময় বেশি লাগে। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও সাক্ষী হাজির করতে না পারার বিষয়টি প্রত্যাশিত নয়। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

১৪ বছরেও এসআই গৌতম হত্যার বিচার হয়নি : ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল মধ্যরাতে বংশাল থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) গৌতম রায় সূত্রাপুর এলাকায় গুলিতে খুন হন। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার এজাহার অনুযায়ী, ঘটনার দিন রাত ২টার দিকে এসআই গৌতম তার পূর্ব পরিচিত শামীম হোসেনের গাড়িতে ওয়ারীর ভাড়া বাসার উদ্দেশে রওয়ানা করেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন শামীমের গাড়িচালক মো. আজম। লালমোহন সাহা স্ট্রিট এলাকায় শামীমের বাসার সামনে এসে গাড়িটি রেখে তারা ধোলাইখালের রাস্তার উত্তর পাশের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় গলির মুখে দাঁড়ানো তিনজনকে তল্লাশি করতে যান এসআই গৌতম। তখন সন্দেহভাজনদের কেউ গৌতমকে গুলি করে। বুকের বাম পাশে ও কোমরের পেছন দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এসআই গৌতম।

এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার আসামি নিয়ে তখন পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এক বছর তদন্তের পর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া হায়দার ও জাকিরকে বাদ দিয়ে পুলিশ ২০১১ সালের ২৭ মার্চ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বর্তমানে এই মামলার চার আসামি তিনজনই জামিনে আছেন। পলাতক রয়েছেন একজন। অভিযোগ গঠনের পর মামলাটির ৪৭ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১২ জন এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি।

নিহত গৌতমের ভাই তিলক রায় টুলু যুগান্তরকে বলেন, ১৩ বছর ধরে মামলা ঝুলে আছে। বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি। পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর বিচারই যদি না হয় এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? তিনি বলেন, খুনের পর পরিবার থেকে বাদী হওয়ার কথা বললেও পুলিশ তা হতে দেয়নি। পুলিশ এ ঘটনায় অস্ত্র উদ্ধারের কথা বললেও সেই অস্ত্র এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটির গুলির খোসার কোনো মিল নেই। এমন অভিযোগপত্র দিয়ে তাহলে কী লাভ হলো? এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে, পুলিশের ভেতরেই কোথাও একটা ঝামেলা আছে। তা না হলে এমন হওয়ার কথা নয়।

সাক্ষী আসে না অন্য মামলায়ও : ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হরতাল-অবরোধের মধ্যে ঢাকার মৎস্য ভবনের সামনের রাস্তায় পুলিশ ভ্যানে পেট্রোলবোমা ছোড়া হয়। এ ঘটনায় কনস্টেবল শামীম মিয়া মারা যান। ঘটনার পরদিন উপপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস। সেখানে আটজনকে আসামি করা হয়। বিচারাধীন এই মামলার ছয় আসামিই এখন জামিনে আছেন। মামলাটির ৫২ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র একজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ হারানো পিস্তলের খোঁজে রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় অভিযান চালানোর সময় অপরাধীদের গুলিতে মারা যান ডিবি পরিদর্শক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় দায়েরকৃত মামলাটি বিচারাধীন। মামলাটির ৩৩ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

দেশ ছেড়েছেন অনেক আসামি : ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বন্ধু রহমত উল্লাহর সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান। পরদিন গাজীপুরের একটি জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, লাশ বস্তায় ভরে জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয়। এ ঘটনায় বনানী থানার মামলায় ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলাটি এখন বিচারাধীন। এখন পর্যন্ত এই মামলার ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২১ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই মামলার আলোচিত আসামি আরাভ খান দেশ ছেড়ে এখন দুবাইয়ে পলাতক রয়েছেন।

২০০৩ সালের ১৫ মে রাতে রাজধানীর মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার এবং এসআই আলমগীর হোসেনকে হত্যা করেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি ও তার সহযোগীরা। এই মামলার বিচারকাজ ১৬ বছরেও শেষ হয়নি। মামলাটিতে ২০০৪ সালে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। চার্জশিটে ৭৫ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০০৭ সালে ৭ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। চার্জ গঠনের পর এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ মামলার চার আসামি জামিনে রয়েছেন। বর্তমান জিসান দুবাইয়ে পলাতক রয়েছেন।

বেশিরভাগ আসামিই জামিনে : রাজধানীর মতিঝিলে ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের সময় নিহত হন এসআই শাহজাহান। এ ঘটনায় ৬ মে মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়। তদন্তাধীন এই মামলাটির ২৪ আসামিই এখন জামিনে। কারাগারে আছেন মাত্র একজন।

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর এএসপি আনিসুল করিমকে আদাবর থানাধীন মাইন্ড এইড হাসপাতালে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। বিচারাধীন এই মামলাটির ১৩ আসামিই এখন জামিনে আছেন। একজন রয়েছেন জেলহাজতে। ২৪ সাক্ষীর অধিকাংশেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি।

২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় নিহত হন কনস্টেবল মো. আমিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় পল্টন থানার মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। এ মামলায় সাত আসামিই এখন জামিনে রয়েছেন।

বিচারাধীন আরও তিন মামলা : ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় তল্লাশি চৌকিতে এক সন্দেহভাজন ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশির সময় দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। বিচারাধীন এই মামলার ২৬ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

২০১৭ সালের ২১ জুন মিরপুর বেড়িবাঁধের বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে প্রায় ৫০০ গজ উত্তরে ঢাকা বোর্ড ক্লাবের সামনে থেকে এএসপি মিজানুরের মরদেহ উদ্ধার করে রূপনগর থানা পুলিশ। তার গলায় কাপড় প্যাঁচানো ছিল। পুলিশ তখন জানিয়েছিল, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ছিনতাইয়ের ঘটনা। বিচারাধীন এই মামলায় এখন পর্যন্ত মাত্র দুজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

২০২১ সালের ১১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের চেকপোস্টে একটি বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কার ফলে নিহত হন পুলিশের এএসআই লিটন মিয়া। ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম যুগান্তরকে জানান, এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ২০২২ সালের ২১ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

রায় ও স্থগিত হওয়া দুই মামলা : ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান নিহত হন। এ ঘটনায় গুলশান থানার মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রায় হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অবরোধ চলাকালে বাংলামোটর মোড়ে বাসে পেট্রোলবোমা ছোড়া হলে তাতে নিহত হন ট্রাফিক কনস্টেবল ফেরদৌস খলিল। এ ঘটনায় রমনা থানার মামলায় ২০১৬ সালের ৪ মে ২৯ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বর্তমানে এই মামলাটি হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে। এ মামলার পাঁচ আসামিই এখন জামিনে রয়েছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ হত্যা মামলায় এ দীর্ঘসূত্রতা সার্বিক বিচারহীনতারই প্রতিফলন। ফৌজদারি মামলাগুলোয় এই দীর্ঘসূত্রতার মূল কারণ সাক্ষী হাজির না করতে পারা। এছাড়া তদন্ত রিপোর্ট দিতে দেরি হয়। ফলে বিচার শুরু হতে অনেক সময় লেগে যায়। এভাবে পাঁচ বছর পার হয়ে গেলে অনেক সাক্ষীকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এসবের পাশাপাশি পুলিশ অপরাধের তদন্তের চেয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে অধিক মনোযোগী। অনেক সময় রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্তার জন্য পুরোনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ফলে মামলার মেরিটও কমে যায়। এতেও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে।

পুলিশ হত্যা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম