তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
জিআই পণ্য নিয়ে তৎপরতা বাড়ছে
বাংলাদেশের জিআই পণ্য ৩১ দুই সপ্তাহে অনুমোদন ১০
মনির হোসেন
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য নিয়ে তৎপরতা বেড়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ির মালিকানা বাংলাদেশ না ভারতের বিরোধের পর ঘুম ভেঙেছে শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি)। ফলে গত ২ সপ্তাহে ১০টি পণ্যের জিআই অনুমোদন দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে বর্তমানে দেশে জিআই পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও বেশ কিছু পণ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিআই পণ্য নিয়ে এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিল সংশ্লিষ্টরা। এখন তাড়াহুড়া করছে। এর কোনোটিই কাম্য নয়। তবে এসব বিষয় মন্তব্য করতে রাজি নয় শিল্প মন্ত্রণালয়। এদিকে জিআই পণ্যের তালিকা চেয়েছেন উচ্চ আদালত।
প্রসঙ্গত, কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পণ্য উৎপাদনে অবদান রাখলে সেটিকে ওই দেশের জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই মানের পণ্য, ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন সম্ভব নয়। এতে পণ্যটির স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই দেশের পণ্য হিসেবে যা বিশ্ববাজারে পরিচিতি পায় এবং রপ্তানিতে ভালো দাম পাওয়া যায়। এছাড়া জিআই পণ্য কোনো দেশ আমদানি করতে চাইলে উৎপাদনকারী দেশকে একটি নির্ধারিত হারে রয়েলটি পরিশোধ করতে হবে। জিআই পণ্য নিয়ে এতদিন বাংলাদেশের কোনো তৎপরতা ছিল না। ভারতের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’কে সে দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একইভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সুন্দরবনের মধুকে। এরপর নড়ে বসে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তর শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাড়ির জিআইয়ের আবেদন হয়। আর সেদিনই তা গ্রহণ করে অনুমোদন গেজেটের জন্য বিজি প্রেসে পাঠায় ডিপিডিটি। এরপর আরও ৯টি পণ্যের জিআই দেওয়া হয়। ফলে এ পর্যন্ত ৩১টি পণ্যের জিআই দেওয়া হলো।
জিআইপ্রাপ্ত পণ্যের মধ্যে রয়েছে-জামদানি শাড়ি, ইলিশ মাছ, বাগদা চিংড়ি, শীতল পাটি, কালোজিরা, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপতি আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহীর সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজারের আগর ও আতর, মুক্তগাছার মন্ডা, জামালপুরের নকশিকাঁথা, রাজশাহীর মিষ্টি পান এবং যশোরের খেজুর গুড়। এ ছাড়াও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে-মধুপুরের আনারস, নরসিংদীর লটকন এবং ভোলার মহিষের কাঁচা দুধের দই।
২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, পাশ হয়। এর দুই বছর পর ২০১৫ সালে হয় বিধিমালা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্যের মান দেওয়া হয়। এরপর স্বীকৃতি পায় আরও ২০টি পণ্য। বাংলাদেশে এ কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে একে পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) নামে অভিহিত করা হয়।
এদিকে জিআই পণ্যের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার ও সরদার মোহাম্মদ রাশেদ জাহাঙ্গীরের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে জিআই পণ্যের তালিকা তৈরি ও সংরক্ষণের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ নয়, জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। রিটকারী আইনজীবী সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ও সুন্দরবনের মধুসহ যেসব বাংলাদেশি জিআই পণ্য ভারত নিবন্ধন করেছে, তার বিরুদ্ধে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আপিলের সুযোগ আছে। এর আগে টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের জিআই হিসাবে নিবন্ধিত হওয়ায় সংশিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আশরাফুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য তার ভৌগোলিক উৎস, মান এবং সুরক্ষার বিষয় জড়িত। টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই দেশ বিভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ চলে গেছে। কিন্তু এই শাড়ির ভৌগোলিক পরিচয় তো তাতে পালটে যেতে পারে না।
তিনি বলেন, ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আপত্তি থাকলে তা করতে হবে। এখন বাংলাদেশের উচিত ভারতের আদালতে মামলা করা। সেটা তিন মাসের মধ্যেই করতে হবে। তাঁর মতে, ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন হয়েছে ২০২০ সালে। এরপর চার বছর চলে গেছে। এসব তথ্য ওয়েবসাইটেই ছিল। কিন্তু এতদিন আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করল? শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরাও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এটা আমাদের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, এখন যেভাবে তাড়াহুড়ো করে জিআই করা হয়েছে, তা অমূলক। এত তাড়াহুড়োয় আবার ভুল হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু সমনামি এবং অভিন্ন পণ্য আছে। এসব পণ্যের জিআই নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। পণ্যগুলোর ন্যায্য সুরক্ষায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। এর মধ্যে-প্যারিস কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (১৮৮৩), মাদ্রিদি এগ্রিমেন্ট অন ইনডিকেটর অব সোর্স (১৮৯১), লিসবনি এগ্রিমেন্ট ফর দ্য প্রোটেকশন অব অরিজিন অ্যান্ড দেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন (১৯৫৮) এবং ডবিউটিওর বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব আইন (ট্রিপস-১৯৯৪)। এসব আইনের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
