Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

১৫ বছরে ব্যয় ১৪ হাজার কোটি টাকা

তবু পানি পাচ্ছেন না এক-তৃতীয়াংশ মানুষ

চট্টগ্রাম ওয়াসায় কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

Icon

এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রাম ওয়াসা গত ১৫ বছরে একের পর এক পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই সময়ে উন্নয়নের নামে সেবা সংস্থাটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ১০ প্রকল্পের বিপরীতে ব্যয় করেছেন ১৪ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় নগরীর ৯০ শতাংশ মানুষ পানি পাচ্ছেন বলে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু এই তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচের পরও এখনো এক-তৃতীয়াংশ নগরবাসী ওয়াসার পানি বঞ্চিত। এছাড়া চলতি মৌসুমে সরবরাহ কমতেই পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এরম ধ্যে ওয়াসার সরবরাহ লাইন কাটা পড়ায় বিভিন্ন এলাকায় সপ্তাহজুড়ে বন্ধ ছিল পানি সরবরাহ। সবমিলিয়ে ওয়াসার পানি নিয়ে নগরবাসীর দুঃখ রয়েই গেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘ওয়াসার পানির উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী। বর্তমানে হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। কেন্দ্রটিতে একটি মাত্র ইউনিট চালু থাকায় পানি ছাড়া হচ্ছে কম। এ কারণে কর্ণফুলী নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির স্তর নিচে নেমে রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কমেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রামে দৈনিক পানির চাহিদা রয়েছে ৫৮ কোটি লিটার। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। তবে গ্রাহকদের মাঝে সরবরাহ করা হয় ৪৫ থেকে ৪৬ কোটি লিটার। বাকি পানি ‘নন রেভিনিউ ওয়াটার’ হিসাবে ধরা হয়। অর্থাৎ বিভিন্নভাবে মানুষ পানি পায় কিন্তু সেই পানির বিল ওয়াসা পাচ্ছে না।’

চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান একেএম ফজলুল্লাহ। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান একেএম ফজলুল্লাহ। সেই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার আমলে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয়। আটটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। দুটি বড় প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে। শেষ হওয়া আট প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। আর চলমান দুই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। একের পর এক প্রকল্প নিলেও নগরীতে পানির সংকট কাটেনি। তবে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বর্তমান সক্ষমতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, গ্রাহকের ৯০ শতাংশই ওয়াসার পানি পাচ্ছে। আর কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীতে শতভাগ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। অথচ ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। এরপরও ৯০ শতাংশ মানুষ পানির আওতায় আসেনি।

সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদকালীন চট্টগ্রাম ওয়াসায় দায়িত্ব পালন করা একেএম ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই কর্মকর্তার নামে দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক বরাবর দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছিলেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের ওই পদক্ষেপের পর ওয়াসা ভবনের একটি কক্ষে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে অফিসের কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে যায়। এরপর অভিযোগ ওঠে, একেএম ফজলুল্লাহর দুর্নীতি ঢাকতে ইচ্ছাকৃতভাবে ওই আগুন লাগানো হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, গত প্রায় ১৫ বছরে একেএম ফজলুল্লাহর প্রশ্রয়ে ওয়াসায় নিয়োগ ও পদোন্নতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন গাড়িচালক মো. তাজুল ইসলাম। এমডি ও তাজুলের অন্তত ৫০ স্বজনকে অনিয়মের মাধ্যমে ওয়াসায় বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়া হয়। দুর্নীতি এবং অর্থের বিনিময়েও চাকরি দেওয়া হয় অনেককে।

জানা গেছে, নগরীতে ৭৮ হাজার ৫৪২টি আবাসিক গ্রাহক এবং ৭ হাজার ৭৬৭টি বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার। নগরীর ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে থাকে। তবে নগরীর অনেক এলাকায় এখনও পৌঁছায়নি পানির সংযোগ। সর্বশেষ পানি সংকট নিরসনের দাবিতে মঙ্গলবার ওয়াসা অফিস ঘেরাও করে কর্মসূচি পালন করেছেন গ্রাহকরা। পরে তারা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়।

ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করেও পানির সংকট দূর করতে পারেনি। তারা ৯০ শতাংশ গ্রাহক পানি পাচ্ছে বলে যে তথ্য প্রচার করছে তা ভুয়া। বাস্তবে এখনো এক-তৃতীয়াংশ নগরবাসী ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত। একটু সুপেয় পানির জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম