অগ্নিসুরক্ষা ছাড়াই চলছে ট্রেন
১৬ বছরে ১৯৫ অগ্নিকাণ্ডে ২৩ মৃত্যু * মৃত যাত্রীর ক্ষতিপূরণ মাত্র ১০ হাজার টাকা * যাত্রীসেবা নিশ্চিতে অগ্নিনির্বাপণের বিকল্প নেই : উপদেষ্টা
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ যাত্রী পরিবহণ হিসাবে রেলের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই রেলেই নেই কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। ফলে গেল ১৬ বছরে ১৯৫টি অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা পাঁচগুণের বেশি। রেলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের স্মৃতিতে এখনো তাজা। ভয়াবহ সেই আগুন বহু নিরপরাধ যাত্রীকে অঙ্গার করে দিয়েছে। ভস্মীভূত কোচ-ইঞ্জিনের ধ্বংসাবশেষ ঢাকতে ফের ঝালাই-রং করা হলেও স্বজন হারানোর আর্তনাদ-আহাজারি ঢাকা যায়নি। কিন্তু, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ, আওয়ামী সরকারের সময় রেল উন্নয়নের নামে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার অর্ধেকেরও বেশি লুটপাট করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ রেলের সাবেক সেই পাঁচ মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সচিব, আর কর্মকর্তাদের নামে দুদকে এখন অন্তত ১৭টি মামলা চলমান রয়েছে।
নিয়মিত ট্রেন যাত্রী রাশেদুল ইসলাম বলেন, ট্রেনে প্রায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। আতঙ্ক নিয়ে ট্রেন ভ্রমণ করতে হয়। আগুনের সঙ্গে পাথর নিক্ষেপের ভয়ও রয়েছে। বিশেষ করে ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা যতটা মর্মান্তিক, ঠিক ততটাই উদ্বেগের। কারণ ট্রেন বা কোনো স্টেশনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। একই উদ্বেগের কথা জানিয়েছে রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর। এদের সূত্র বলছে দিন দিন ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে অগ্নি দুর্ঘটনাও। রেলপথে অগ্নিনির্বাপণের কোনো সুরক্ষা ছাড়াই ট্রেন চলছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোনো ট্রেনে আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন দাঁড় করানো সম্ভব হয় না। এতে আগুন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। তখন সাধারণ যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে ট্রেন থেকে লাফ দেন, এতেও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের উন্নত সব দেশের রেলওয়েতে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। ফায়ার স্টেশন-ফায়ার সার্ভিস যান, প্রশিক্ষিত লোকবলসহ আলাদা ইউনিট রয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশ রেলওয়েতে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে রেলপথে, ট্রেনে, স্টেশনে আগুন লাগলে ব্যাপক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রাণহানি ঘটে। ১০৯টি আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে বাংলাদেশ রেলে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ট্রেনের প্রতিটি কোচে দুটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, আন্তঃনগর ট্রেনের গুটি কয়েকটিতে নামে মাত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখা গেছে। লোকাল-মেইল, কমিউটার ট্রেনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা একেবারেই শূন্য। রেলওয়ের তথ্য বলছে, পুরো রেলের কোথাও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নেই। লোকবল তো নেইই-রেলের কাউকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। ফলে হঠাৎ আগুন লাগলে রেলের কিছুই করার থাকে না।
১৬ এপ্রিল কক্সবাজারগামী চলন্ত ট্রেন প্রবাল এক্সপ্রেসে আগুন লাগে। ট্রেনের ‘ড’ কোচে আগুন লাগার পর তা অন্য কোচে ছড়াতে থাকে। ওই সময় আতঙ্কিত যাত্রীরা জীবন বাঁচাতে অনেকে জানালা দিয়ে লাফ দেন। আবার অনেকে দরজা দিয়ে দ্রুত ট্রেনে থেকে নেমে পড়েন। এদের মধ্যে এক দম্পতি তাদের ৮ মাসের শিশুকে নিয়ে ট্রেন থেকে লাফ দেন। এতে গুরুতর আহত শিশুটি মৃত্যুবরণ করে। ওই আগুনের ঘটনায় শিশুর মা-বাবাসহ অন্তত ৭০ জন আহত হন।
সরেজমিন বিভিন্ন ট্রেন, স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই নেই। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর গুটি কয়েকটিতে নামেমাত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশার চোখে পড়েছে। বেশিরভাগ আন্তঃনগর ট্রেনেই আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া লোকাল-মেইল, কমিউটার ও আন্তঃনগর ট্রেনে পানির ব্যবস্থা থাকলেও, সেই পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন আউটার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে-এতে অন্তত ৫ যাত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। আহত হন প্রায় শতাধিক। মাত্র ১০০০ ফুট দূরত্বে থাকা কমলাপুর স্টেশনেও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না। ট্রেনে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষণিকের মধ্যেই একে একে ৫টি বগি পুড়ে যায়। তবে আগুন নেভাতে খিলগাঁও ও পোস্তগোলা ফায়ার স্টেশনের ৭টি ইউনিট কাজ করে। এর আগে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন লাগায় মা ও শিশুসহ অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়।
রেললাইনের বিভিন্ন সেকশনে বাউন্ডারি থাকে, তাছাড়া বিশাল বিল, হাওড়, পাহাড়সহ বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ট্রেন চলাচল করে। তখন ট্রেনে আগুন লাগলে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে থাকা ফায়ার সার্ভিস দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর মতো কোনো সড়কই থাকে না।
রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় ১৬ বছরে রেলে ১৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরে মহুয়া কমিউটার ট্রেনের পাওয়ার কারে আগুন লাগার পর দুটি বগি পুড়ে যায়। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের আগুনে অন্তত ৭টি কক্ষ পুড়ে যায়। ২০২২ সালের ১১ জুন ভানুগাছা-শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লেগে ৩টি কোচ পুড়ে যায়। আহত হন অর্ধশত যাত্রী। বিগত প্রায় ১৬ বছরে এমন ঘটনায় বহু যাত্রী এখনো আহত অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। ক্ষতিপূরণও পাচ্ছেন না। রেলওয়ে আইনে মৃত যাত্রী মাত্র ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ টাকা তুলতেই অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে যায়।
রেলের সাবেক এক মহাপরিচালক (ডিজি) যুগান্তরকে বলেন, রেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো প্রকল্প বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কারণ, ট্রেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানেই বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ফাঁসানোর ফাঁদ। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের নামে রেলে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেও অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে কেউই আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয় যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে-এমনটা সাধারণ যাত্রীদেরও দাবি।
রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, ‘রেলে যাত্রী নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এটা নিশ্চিত না হলে রেলের কোনো উন্নয়নই টেকসই হওয়ার কথা নয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার রেলে উন্নয়নের নামে হরিলুট করেছে। আমরা পুরো রেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করছি। ট্রেন যাত্রী এবং মাঠপর্যায়ে থাকা রেলওয়ে ম্যানদের নিরাপত্তায় ফায়ার স্টেশন, প্রশিক্ষিত লোকবলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিটি ট্রেনেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
