Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি সেন্টমার্টিন

যাতায়াতে বিকল্প পথ তৈরি করলে ১২ মাসই পর্যটকরা আসা-যাওয়া করতে পারবেন

Icon

মুহাম্মদ আবুল কাশেম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের মূল ভূখণ্ডের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর আদি নাম নার্জিল জাজিরা বা জিঞ্জিরা। জাজিরা থেকে জিঞ্জিরা শব্দের উৎপত্তি। জাজিরা আরবি শব্দ। এর অর্থ উপদ্বীপ। ঐতিহাসিকদের মতে, আরব্য বণিকদের বাণিজ্যিক জাহাজ এ দ্বীপে যাত্রাবিরতি করত। তারা একে নার্জিল জাজিরা বা নারিকেল উপদ্বীপ বলত। পরে ‘নার্জিল জাজিরা’ কালক্রমে স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ হয়ে যায়। এ দ্বীপে নারিকেল গাছের আধিক্য ছিল বেশি। এখনো দ্বীপের ঐতিহ্য নারিকেল গাছ। ১৮৮৮ সালে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন এর নামকরণ করা হয় সেন্টমার্টিন।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রথম মানববসতি স্থাপনের প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৯০ সালে। তখন থেকে কিছু বাঙালি এখানে বসবাস শুরু করেন। তারা মৎস্যজীবী ছিলেন। দ্বীপের উত্তরাংশে মাত্র ১৪টি পরিবার বসতি শুরু করেছিল। বর্তমানে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। বাকিরা ব্যবসা বা চাকরি সূত্রে বসবাস করেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৮০১ একর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি মাত্র ৩৮১ একর। দ্বীপের প্রধান ফসল ধান, তরমুজ, পেঁয়াজ ও মরিচ।

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এ দ্বীপটি আনন্দের ও বিনোদনের জায়গা হলেও দ্বীপবাসীর কাছে এটি একটি বাসস্থানের নাম। দ্বীপে একটি পুলিশ ক্যাম্প, একটি বিজিবি ক্যাম্প, একটি নৌবাহিনী ক্যাম্প, একটি কোস্টগার্ড ক্যাম্প, একটি বাতিঘর, একটি পোস্ট অফিস ও একটি জেলা পরিষদ পরিচালিত ডাকবাংলো আছে। এছাড়া হোটেল ও কটেজ আছে প্রায় ১৫০-২০০টি। দ্বীপের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১০ শয্যাবিশিষ্ট হসপিটাল। অভ্যন্তরীণ যানবাহন রিকশা ও ভ্যান। দ্বীপবাসীর প্রধান পেশা মাছ ধরা। দ্বীপটি এক সময় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড ছিল। ১৯৮০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেন্টমার্টিন সফরকালে এ দ্বীপকে পৃথক ইউনিয়নের ঘোষণা দেন।

দ্বীপে প্রধান দুটি অংশ হলো-উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়া। মাঝখানের সংকীর্ণ অংশের নাম গলাচিপা। একেবারে দক্ষিণে রয়েছে ছিরাদিয়া, যা জোয়ারের সময় মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনটি ছোট দ্বীপের রূপ ধারণ করে। দ্বীপের উত্তর-পূর্ব অংশ ছাড়া প্রায় সম্পূর্ণ তীরবর্তী অঞ্চলই পাথরময়। এ দ্বীপের ঐতিহ্য নারিকেল, কেয়া ও নিশিন্দা গাছ। রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল ও ১৫৭ প্রজাতির স্থলজ গুপ্তবীজী উদ্ভিদ। এছাড়া এখানে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক ও ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী আছে। দ্বীপে ৬৭ প্রজাতির স্থানীয় পাখি ও ৫৩ প্রজাতির অতিথি পাখিসহ মোট ১২০ প্রজাতির পাখি এবং ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে।

দ্বীপটি বাংলাদেশের পর্যটন খাতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি ভৌগোলিকভাবে ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। নীল সাগরের জলরাশির মিতালি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই দ্বীপকে দেখতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে লাখো পর্যটকের ঢল নামে। যেখানে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য তাদের মুগ্ধ করে। তাই পর্যটন খাতে এ দ্বীপের গুরুত্ব অনেক বেশি।

স্থানীয় বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। যাতায়াতের একমাত্র সুযোগ নৌপথ। নাফ নদীর নাব্য সংকটের কারণে সেন্টমার্টিন পৌঁছানোর সময় নাইক্ষ্যংডিয়া নামক জলসীমা থেকে প্রায়ই মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সেন্টমার্টিনগামী বোট বা ট্রলার ধরে নিয়ে যায়। এ কারণে বিকল্প পথে সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের পথ তৈরি করলে বছরের ১২ মাসই পর্যটকরা আসা-যাওয়া করতে পারবেন। এতে দেশের অর্থনীতিও চাঙা হবে। এ বিষয়ে পরিবেশবিদ সমুদ্র গবেষক আহমদ গিয়াস যুগান্তরকে বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রথমে ইকো সিস্টেম চালু করতে হবে এবং সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পোন্নয়নে প্রধান্য দিতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে এটিকে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, এখানে পরিবেশবান্ধব আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রাখা যাবে না। যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকরা নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করতে পারেন এবং মানসম্মত পরিবেশ বজায় রেখে তাদের আবাসন ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় তাহলে প্রতিবছর জাতীয় রাজস্বের বড় একটা অংশ এখান থেকে আসবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ দূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পেছনে রয়েছে-অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক আগমন, আবাসিক হোটেলগুলোর অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ব্যবহারিক সামগ্রী সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন ইত্যাদি। অনেকে বলছেন, সেন্টমার্টিনের নতুন জন্মানো প্রবাল জেলেদের জালের টানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই পরিকল্পিত সেন্টমার্টিন গড়তে জেলেদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

স্থানীয়রা জানান, এখানে শিক্ষার জন্য মাত্র একটি প্রাইমারি স্কুল ও উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। চিকিৎসার জন্য নামেমাত্র ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময় নিয়মিত সেবা মেলে না। কোনো পর্যটক হঠাৎ অসুস্থ হলে প্রাথমিক সেবা ছাড়া বড় ধরনের কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম