নিশ্চিত করা যাচ্ছে না শিক্ষার গুণগত মান
কারিগরি শিক্ষায় সংকট বাড়ছে
প্রশিক্ষক ও অধ্যক্ষের অর্ধেক পদ শূন্য * নেই হাতে-কলমে শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ * সমস্যাগুলো গুরত্ব সহকারে দেখছি -সচিব কবিরুল
হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়ছে নানা ধরনের সংকট ও চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, বিনিয়োগস্বল্পতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক সংকট প্রকট আকারে ধারণ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া নতুন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষক এবং অধ্যক্ষের পদ অর্ধেকের মতো শূন্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ল্যাবের সংখ্যা অপ্রতুল এবং ব্যবহারযোগ্য ল্যাবগুলোর অধিকাংশ নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। সেখানে নিয়মিত হচ্ছে না ক্লাস। একই সঙ্গে রয়েছে অবকাঠামো সমস্যাও। ফলে কারিগরি শিক্ষায় দিন দিন বাড়ছে নানা ধরনের সংকট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ট্রেডভিত্তিক শিক্ষকের অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব। মানবসম্পদ এবং প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই নতুন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এতে প্রশিক্ষক ও অনেক প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের পদ বর্তমানে শূন্য। এছাড়া ট্রেনিং অব ট্রেইনার্স (টিওটিগুলো) অনিয়মিত এবং প্রশিক্ষণের মান শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নয়। আর কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যেভাবে কথা হয়, সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক শিক্ষা পায় না। এতে কারিগরি শিক্ষার মানে ঘাটতি থাকছে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগও কম। আবার বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীরা ডিগ্রিধারী হলেও চাকরি পাচ্ছে না। এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে এখনো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা কারিগরি শিক্ষার সমস্যাগুলো খুব গুরত্ব সহকারে দেখছি। এই নিয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। এছাড়া পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। আগে যে কোন বয়সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটি এখন আর থাকবে না। আর শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়গুলো আস্তে-ধীরে সমাধান হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগে ১৭ ভাগ শিক্ষক থাকলেও সেটি বর্তমানে ৫০ শতাংশে এসেছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। এতে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
জানা যায়, দেশে তিন স্তরের কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে আছে দুই বছর মেয়াদি এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দুই বছর মেয়াদি এইচএসসি (ভোকেশনাল) এবং ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে ডিপ্লোমা কোর্স পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থাও আছে। এতে ১২ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হয়। দেশে সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গত শিক্ষাবর্ষে এক লাখের বেশি আসন ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সরকারি থাকলেও অধিকাংশই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এছাড়া এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসিতেও (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বা বিএম) বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা রয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চার বছর মেয়াদি ১০ ধরনের ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে। এগুলো হলো-ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন অ্যাগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন ফিশারিজ, ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক, ডিপ্লোমা ইন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (নেভাল), ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্মি) ও ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। ৩২টি ট্রেডে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ আছে। অবশ্য সব প্রতিষ্ঠানে সব ট্রেড নেই। মূলত এসএসসি পাশের পর চার বছর মেয়াদি এসব কোর্সে ভর্তি করা হয়। দেশে ৫৬টি সরকারি ও ৫৭২টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এসব কোর্সে পড়ানো হয়।
জানা যায়, কারিগরি প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে অর্জিত দক্ষতা বাজার চাহিদার যথাযথভাবে প্রতিফলন করতে পারছে না। যদিও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৫টি বৃত্তিতে এবং ৪৬টি ভাষায় প্রশিক্ষণ প্রদান করে, তথাপি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর বাজার চাহিদা নিয়মিতভাবে বিশ্লেষণ করা এবং সে অনুযায়ী পাঠ্যক্রম উন্নয়ন করতে না পারা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর একটি বড় ব্যর্থতা। যার ফলে কারিগরি শিক্ষায় প্রদত্ত সনদপত্র আন্তর্জাতিক প্রত্যয়নকারী সংস্থার মানও পূরণ করছে না। এছাড়াও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাবে প্রথাগত শিক্ষার বাইরে কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ সীমিতই থেকে যাচ্ছে। এছাড়াও বিদ্যমান পাঠ্যক্রম সম্পর্কিত তথ্যের ব্যাপক প্রচার এবং সম্ভাব্য শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার অন্তর্গত ট্রেডগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন- মেকানিক্যাল এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও এ ট্রেডগুলোর ভিত্তিতে এই মফস্বল অঞ্চলে যথাযথ কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। চাকরি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অপ্রতুলতা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ২০২২ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৮২টি। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ১৫৪টি, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট ৫১টি, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে ৩৩৬টি। এছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষক আছেন ১২ হাজার ৮৯৪ জন। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষক আছেন ১ হাজার ৮৮৭ জন এবং টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে ৪ হাজার ৭৭ জন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩ লাখ ৯ হাজার ১৪১ জন। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে ১৬ হাজার ১৩১ জন, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে ১০ হাজার ৮৫২ জন এবং টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯২১ জন।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি কারিগরি শিক্ষা নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে। সেখানে উঠে এসেছে, নারীর সামাজিক গতিশীলতার অভাব শিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এলাকার বাইরে কাজ করতে যেতে চান না। পর্দা পালনে ব্যাঘাত ঘটার দরুণ চ্যালেঞ্জিং পেশাসংক্রান্ত কোর্সগুলোতে (যেমন-যানবাহন চালনা, ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং) নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়। অবকাঠামোগত দুর্বলতা যেমন ওয়াশরুম ব্যবস্থাপনা ভালো না হওয়ার কারণে নারী শিক্ষার্থীরা অসুবিধায় পড়েন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো কারিগরি শিক্ষাকে মিস্ত্রি তৈরির শিক্ষা মনে করেন। নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও কারিগরি শিক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ সীমিত।
ছয় দফা পূরণে দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা ১৬ এপ্রিল থেকে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। সপ্তাহখানেক ধরে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের দাবি বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়নে কমিটি গঠন করে। একই দাবিতে ২৯ এপ্রিল থেকে দেশের বেশিরভাগ পলিটেকনিকে তালা ঝুলিয়ে শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
