শহীদ ও গুমের শিকার পরিবারের আর্তনাদ
কী করছে রাষ্ট্র, কবে মিলবে বিচার
চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না তারেক রহমান, একই অবস্থা অন্যদেরও * একশবার ফোন দিলেও ধরেননি সারজিস হাসনাত : এক শহীদজায়ার আকুতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১ জুলাই। বিকাল সাড়ে ৩টা। হঠাৎই কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র। স্বজন হারানোর আর্তনাদ আর ফেরত চেয়ে আকুতির শব্দে হাজারো মানুষের চোখে নেমে আসে অশ্রু। আবেগতাড়িত হয়ে চোখ মোছেন উপস্থিত জনতা। মঞ্চে এক কিশোরী মেয়ে আকুতি করে তার গুম হওয়া বাবাকে ফেরত চাচ্ছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবাকে না পাওয়ার বেদনা, কষ্টের কথা অনায়াসে বলে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রের কাছে তোলেন নানা প্রশ্ন। তার কান্না ও প্রশ্নের কাছে থমকে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে কিশোরীর আকুতি শুনে এ সময় কেঁদে ফেলেন তিনি। জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যায় চশমার ফাঁক দিয়ে বারবার চোখ মুছছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
মঙ্গলবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ পরিবারের সম্মানে ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভায় এ দৃশ্যের দেখা মেলে। স্বৈরাচারের বিনাশ ঘটানো গৌরবের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এই কর্মসূচির আয়োজন করে বিএনপি। সভায় সারা দেশ থেকে আসা নির্যাতিত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনরা কষ্ট ও ভোগান্তির গল্পগুলো তুলে ধরেন। জানান, স্বজন হারানোর বেদনার সঙ্গে আর্থিক টানাপোড়েন, সন্তান আর তার ভবিষ্যতের চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা পারভেজের কিশোরী কন্যা আবিদা ইসলাম হৃদি বলেন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখে আমার বাবাকে শাহবাগ থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১২ বছর হয়ে গেল আমি আমার বাবাকে এভাবেই খুঁজছি। ৫ আগস্টের পর আমাদের অনেক আশা ছিল, এখন সময় এসেছে আমার বাবাকে ফেরত পাওয়ার। চাচ্চুদের ফিরে পাওয়ার। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তাদের খোঁজও পাইনি। আমরা কবে তাদের খোঁজ পাব? আমরা ৫ দিন আগে আয়নাঘরে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি আমার নামটা দেখতে পাই। আমার বাবা কত কষ্ট করে আমার নামটা লিখেছে। আয়নাঘরের অনেক লেখা মুছে ফেলেছে। স্বৈরাচার সরকার তো নাই, তাহলে কে মুছল এগুলো?
আবিদা বলেন, আমরা কি আমাদের বাবাদের ফেরত পাব না? আমরা কি স্বাধীন দেশে স্বাধীন পথে হাঁটতে পারব না? আমার ভাই (ছোট) কি আমার বাবার মুখটা দেখতে পারবে না? আমরা কবে বাবাকে ফিরে পাব? আমাদের স্বপ্নগুলো কে পূরণ করবে? রাষ্ট্র যেহেতু আমাদের বাবাদের গুম-খুন করেছে, এই রাষ্ট্রকেই আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। পারভেজকন্যা আরও বলেন, আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। এভাবে আর কান্না করতে চাই না। আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাই। আমাদের স্বপ্ন কে পূরণ করবে। আমি এই গুম শব্দটার সঙ্গে থাকতে চাই না। আমাদের নাম হয়ে গেছে, সবাই বলে গুম পারভেজের মেয়ে।
আরোয়া নামের আরেক শিশু বলে, আমার বাবাকে দেখতে চাই। ফেরত চাই। আমার বাবা আসে না। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন ও মায়ের ডাক সংগঠনের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, গুম-নিখোঁজ হয়ে যারা ফেরত আসেননি এবং জুলাইয়ে আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের হত্যার বিচার আমরা চাই। ইনশাআল্লাহ যতদিন আমাদের শেষ রক্ত আছে, এই বিচার কায়েম করে ছাড়ব। ওরা (আওয়ামী লীগের পুলিশ) বলেছিল না-একটাকে মারি, একটাই মরে, বাকিরা যায় না। আমরা যাব না, বাংলাদেশে কোনোদিন ফ্যাসিজম কায়েম হতে দেব না।
তুলি বলেন, আমরা জানি, তখন থেকেই শেখ হাসিনার কফিনে পেরেক মারা শুরু হয়েছে যখন এই ছোট ছোট শিশুরা, এই ভাবিরা, এই মায়েরা আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে রাজপথে শুধু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, গুম করে দেওয়া সন্তানদের ছবিগুলো বুকে ধারণ করেছিল। তাদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ আবদুল্লাহ বিন জাহিদের পরিবারের খোঁজ কেউ নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তার মা ফাতেমা তুজ জোহরা। গণ-অভ্যুত্থানের পর এনসিপি নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে বারবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বিমানবন্দর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আবদুল্লাহ বিন জাহিদ।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে জোহরা বলেন, আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে আবদুল্লাহ বিন জাহিদের বয়স ছিল ১৭ বছর, ছোট ছেলের ১৪ বছর। আমার বড় ছেলে মারা যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় ছোট ছেলের ক্যানসার ধরা পড়ে। সে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ১৮ মে আমার স্বামী স্ট্রোকে মারা যান। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ থেকে আমার ছোট ছেলের খোঁজখবর নিয়েছে এবং তার চিকিৎসার খরচ দিয়েছে। শুক্রবার ছোট ছেলের আরেকটা অপারেশন হবে। আমার শেষ অবলম্বনটুকু যেন আমার কাছে থাকে এজন্য সবাই দোয়া করবেন। তিনি বলেন, এই উপদেষ্টা পরিষদ ও অন্তর্বর্তী সরকার আজ পর্যন্ত আমাদের খোঁজ নিতে পারেনি। আমার ছেলের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা পেল, তারা একবারও আমাদের খোঁজ নিল না। এমনকি সারজিস-হাসনাতকে আমরা ১০০টা ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেন না। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ আজ আমাদের সঙ্গে না থাকলে আমাদের আজ রাস্তায় নামতে হতো। আমার ছোট ছেলেও আজ দুনিয়ায় থাকত না, যোগ করেন ফাতেমা তুজ জোহরা। শহীদ ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের সন্তানরা তাদের রক্ত দিয়ে এই দেশ থেকে ফ্যাসিস্টদের বিতাড়িত করেছে। আমরা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমি সব শহীদ ও গুম হওয়া পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের সন্তান হত্যার বিচার চাই। বর্তমান সরকার যদি এই বিচারকাজ করতে না পারে, তাহলে একটা বড় দল হিসাবে বিএনপির কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সব গুম, হত্যার বিচার করবে। শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে এই দেশ মুক্ত হয়েছে। শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, আজকে আমরা এভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারছি, এটা অনেক বড় ভাগ্য। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ যদি বুক পেতে না দাঁড়াত, তাহলে আজকে হয়তো পরিস্থিতি এত সহজ হতো না। আমি মনে করি, প্রথম শহীদ আবু সাঈদ বুক পেতে দলবল নির্বিশেষে সবার সাহস জুগিয়েছিল। যার কারণে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। আমরা সবাই একটা বাকস্বাধীনতা পেয়েছি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রথমেই শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আশা করছি আগামীদিনেও এই শহীদ ও আহতদের পাশে থাকবে বিএনপি।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়া নাবিল বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করেছি, কিন্তু বৈষম্যের শিকার আমরা আহতরা। আজকে আমাদের চিকিৎসা হয় না। আহত ভাইদের হাসপাতালে ঢুকতে দেয় না। বিএনপির কাছে আবেদন, আপনারা হাসপাতালে গিয়ে আমাদের দেখেন। আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন।
চট্টগ্রামের শহীদ ওয়াসিম আকরামের বাবা সফি আলম বলেন, আমার ছেলে চট্টগ্রামের ষোলো শহরে গুলিবিদ্ধ হয়। তখন আমি ছিলাম বাহিরে। আমরা খবর পাওয়ার আগে আমাদের নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবর পেয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তুমি চিন্তা করো না। একটা ছেলে গেছে আরও অনেক ছেলে তোমার পাশে আছে। কিন্তু এটা সত্যি। আমার ছেলে চলে গেছে, এখন আমি ঢাকা এলে ৫০টা ছেলে পাই, কক্সবাজারে গেলে ২০০ ছেলে হয়। মানুষ আমাকে সম্মান করে। এটা আমার ছেলে আমাকে দিয়ে গেছে। এখন আমাদের পাশে তারেক রহমান আছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদ নুরুজ্জামান জনির ভাই মনিরুজ্জামান হিরা বলেন, ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি আমাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে আমাকে দেখতে গিয়ে আমার ভাই আটক হন। দুপুর ২টায় তাকে আটক করা হলে ওই দিন রাত ২টায় ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ শুধু সে রাজনীতি করত। একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি করতে হয়? ভাইয়াকে ১৮টি গুলি করে বুকটা ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছে। হাতের তালুতে গুলি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ)। সেই স্মৃতি বর্ণনা করে তার বাবা অনন্ত দাস বলেন, আজ এখানে আমি আমার ছেলে হত্যার বিচারের জন্য এসেছি। এখানে এসে দেখি আমার মতো হাজার হাজার বাবা-মা তাদের সন্তান হত্যার বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি না এলে এই অবস্থা দেখতে পারতাম না। কত বছর পার হয়েছে, অথচ বিগত সরকার আমার ছেলে হত্যার বিচার করেনি। দিবালোকে অন্যায়ভাবে আমার ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর সুষ্ঠু বিচার পাইনি। আমি যেন আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।
বুয়েটের শিক্ষার্থী শহীদ আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, দেশের পক্ষে কথা বলার কারণে ২০১৯ সালে আমার ছেলেকে ৬ ঘণ্টা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আমার ছেলে হত্যার বিচার এখনো পাইনি। তার কী অপরাধ ছিল? জুলাই অভ্যুত্থানে সাভারে শহীদ হওয়া ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন বলেন, শান্তির স্বার্থে শুধু সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে শহীদ পরিবার (জুলাই অভ্যুত্থান) থেকে সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ১০ জন প্রতিনিধি মনোনয়নের আশা করেন বলে জানান তিনি। মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শহীদ পরিবার থেকে অংশীদারত্ব রাখতে হবে।
এ সময় বক্তৃতা করেন, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বোন সায়মা ইসলাম ফারিন, রাজশাহীর শহীদ শেখ ফাহানি জাফরের মা কাজী লুলন মাতনিন, চোখের দৃষ্টি হারানো রেদোয়ান হোসেন রিয়াদ প্রমুখ।
