নিপীড়ন-নির্যাতন ছিল যার নেশা
ঝিনাইদহের ভয়ংকর এসপি আলতাফ আজও অধরা
মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নিপীড়ন-নির্যাতন করাই ছিল তার নেশা। আটক ব্যক্তির বুকের ওপর লাফালাফি করে পেতেন আনন্দ! কথিত ক্রসফায়ারে দিয়ে করতেন উল্লাস। গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ কিলার গ্যাং। দুহাতে কামিয়েছেন টাকা। বাগিয়েছেন লাভজনক পোস্টিং। স্বনামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তিনি ছিলেন হিন্দি সিনেমার ভিলেনের চেয়েও ভয়ংকর। যার নামের আগে ‘গোল্ড’ যুক্ত হয়েছে। তিনি ঝিনাইদহের সাবেক পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন (বর্তমানে চাকরিচ্যুত)। ঝিনাইদহে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে অন্তত ৮টি। কিন্তু আজও কেউ তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি। বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন আলতাফ গ্যাংয়ের পুলিশ সদস্যরা। দীর্ঘ অনুসন্ধানে মিলেছে এমন ভয়াবহ চিত্র। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঝিনাইদহের ২২তম এসপি হিসাবে যোগদান করেন আলতাফ হোসেন। এর কয়েকদিন পর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। জেলাজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হরিণাকুণ্ডুতে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল ফারুক হোসেন। কোটচাঁদপুরে তৎকালীন ওসিসহ আহত হন অন্তত ৬ পুলিশ সদস্য। বিষয়খালী, ডাকবাংলা, তেঁতুলতলা, কোটচাঁদপুর, মহেশপুরসহ গোটা জেলায় বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ওই সময় আলতাফের প্রথম সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান রিপন (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি)। সদর সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন এএসপি নজরুল ইসলাম।
২০১৩ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় বেপরোয়া গ্রেফতার বাণিজ্য। চলতে থাকে গণগ্রেফতার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, কথিত নাশকতার চেষ্টাসহ বিভিন্ন মামলায় জামায়াত-বিএনপি ও শিবিরের অন্তত ১৪০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। রাতে সন্দেহভাজনদের থানা-ফাঁড়িতে এনে পেন্ডিং মামলা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেন কিছু অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা। নিপীড়ন-নির্যাতনের উৎসব শুরু হয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন মহেশপুরের এক নিরীহ কৃষক। নির্যাতন চালানো হয় নারী, পুরুষ, শিশুসহ সব বয়সের মানুষের ওপর।
আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন এসপি আলতাফ : ২০১৫ সালের মে মাসে বদলি হন আলতাফের সেকেন্ড ইন কমান্ড তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান (রিপন)। আলতাফের দ্বিতীয় সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে যোগদান করেন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ (বর্তমানে এসপি, পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত)। তার বিরুদ্ধেও হয়েছে হত্যাসহ অন্তত ৯টি মামলা। এএসপি নজরুল ইসলাম বিদায় হলে ঝিনাইদহ সদর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে যোগ দেন গোপীনাথ কানজি লাল। পুলিশের নির্যাতন আর গায়েবি মামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
২০১৬ সালের প্রথমদিকে এসপি আলতাফ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। হোমিও চিকিৎসক ধর্মান্তরিত বৃদ্ধ সমির খাজা, শিয়া ধর্মের আব্দুর রাজ্জাক, পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী এবং সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর সামনে আসে হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি। ‘জঙ্গি’ নিধনের নামে চলে লাগামহীন নির্যাতন ও হত্যা।
ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনসসহ জেলার অন্তত ১১টি পুলিশ ক্যাম্পের গোপন আয়নাঘরে আটকে রেখে পুরোহিত হত্যার ঘটনায় সাজানো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন চালানো হয় শিবির নেতা কালীগঞ্জের আবুজার গিফারি, ঝিনাইদহ শহরের ইবনুল ইসলাম পারভেজ, ছাত্রদল কর্মী মিরাজুল ইসলাম, শৈলকুপার সাইফুল ইসলাম মামুন, কোটচাঁদপুরের স্কুলশিক্ষক স্থানীয় জামায়াত নেতা এনামুল হক বিশ্বাস, আবুল কালাম আজাদ, কালীগঞ্জের শামিম হোসেন, জেলা শহরের আরাপপুরের ডা. তারেক হাসান ওরফে সজিব, হরিণাকুণ্ডুর ইদ্রিস আলী ওরফে পান্না হুজুরসহ অসংখ্য ব্যক্তিকে। নির্মম নির্যাতনের পর কথিত ক্রসফায়ারে প্রাণনাশ করা হয় তাদের। এ সময় র্যাব-পুলিশ পাল্লা দিয়ে কথিত ক্রসফায়ারে লিপ্ত হয়। গুম করা হয় অসংখ্য ব্যক্তিকে।
আয়নাঘর থেকে জীবিত ফিরতে পেরেছিলেন তবিবুর রহমান : আলতাফের আয়নাঘর থেকে জীবিত ফিরেছিলেন কোটচাঁদপুর উপজেলার চাঁদপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেন বিশ্বাসের ছেলে কৃষক তবিবুর রহমান বিদ্যুৎ। তিনি জানান, নিজ গ্রাম থেকে প্রথমে সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলে তিনজন মিলে চোখ ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে রাখা হয় কালীগঞ্জ থানায়। সেখানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। এরপর পুলিশ লাইনসের একটি পোকা-মাকড়ে ঠাসা ঘরে আটকে রাখে। দুই দিন পানি পর্যন্ত পান করতে দেওয়া হয়নি। নির্যাতনের সময় গরম পানি থেরাপি দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করে। অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মারধর, নির্যাতন করতে থাকে। বিদ্যুতের দেওয়া তথ্যমতে, আলতাফ (সাবেক এসপি) নিজে বুকের ওপর উঠে উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু পরিবারের কেউ জানে না কোথায় আছে বিদ্যুৎ। আটকের ৭ দিন পর গায়েবি মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয় তাকে।
বীভৎস নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন এনামুল হক : আলতাফ বাহিনীর কাছ থেকে বেঁচে ফিরেছেন সদর উপজেলার আড়মুখ গ্রামের এনামুল হক। তাকে ২০১৬ সালের জুনে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আটক করে ঝিনাইদহ পুলিশ। সেসময় আরও আটক করা হয় শিবির নেতা ঝিনাইদহ শহরের ইবনুল ইসলাম পারভেজ, আনিচ, শহীদ আল মাহমুদসহ ৫ জনকে। এনামুল হক জানান, ওই সময় ছিল রমজান মাস। পুরোহিত হত্যার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে, ডিম থেরাপি, বৈদ্যুতিক শকসহ নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। দীর্ঘদিন ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনসের আয়নাঘরে বিবস্ত্র করে আটক রাখার পর স্বীকারোক্তি দেওয়ার শর্তে আদালতে পাঠানো হয় এনামুলকে। আটক অপর চারজনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা অন্য একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্লায়ার্স দিয়ে আঙুলের নখ, চোখ পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয় ক্রসফায়ারে নিহতদের। এমন অসংখ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে গোটা জনপদে। পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধের জুডিশিয়াল তদন্তে বৈধতা দিয়েছিলেন ওই সময় জেলায় কর্মরত জেলা প্রশাসকরা।
সবশেষ ৯টি হত্যা মামলার নথি যুগান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, ৮টি মামলার প্রধান আসামি সাবেক এসপি আলতাফ হোসেন। তারেক হাসান সজিব হত্যার অভিযোগসহ ৯টি হত্যা মামলা হয়েছে সেকেন্ড ইন কমান্ড সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখের বিরুদ্ধে। এছাড়া অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার গোপীনাথ কানজিলাল, সদর থানার তৎকালীন ওসি হাসান হাফিজুর রহমান, হরেন্দ্রনাথ সরকার, এসআই আমিনুর রহমান, এসআই প্রবীর মৈত্র, কোটচাঁদপুর সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম, এসআই মিজানুর রহমান, এসআই সৈয়দ আলী, তৎকালীন এসআই শাহরিয়ার হাসান, পরিদর্শক শেখ আলি আহম্মদ, ডিএসবির ওয়াচার মুরাদসহ অন্তত দুই ডজন পুলিশ সদস্য। ঝিনাইদহ থেকে এসপি আলতাফ বদলি হন সাতক্ষীরা জেলায়। সেখানেও চালিয়েছেন তাণ্ডব।
পাটকেলঘাটায় স্বর্ণ চোরাকারবারি বিপ্লব চ্যাটার্জি নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১২০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধারের পর মাদক বানিয়ে স্বর্ণ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। পরে সিলেট রিজিয়নে ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার থাকা অবস্থায় ২০২২ সালের ১৮ মে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আলতাফকে।
সরকারি আইনজীবী (পিপি) এসএম মশিউর রহমান বলেন, সাবেক পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেনসহ দুই ডজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। আদালতের কাছে বা পিপির দপ্তরে কোনো তথ্য পাঠানো হয়নি। ফলে হতাশ বিচারপ্রার্থী নিহতের স্বজনরা।
