প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যবই ছাপা
এবারও কাজ পাচ্ছে আওয়ামী সিন্ডিকেট
সবকিছু অনলাইন হওয়ায় আমাদের করার কিছু নেই -এনসিটিবি সচিব
হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বই ছাপানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও ইবতেদায়িসহ ৮টি শ্রেণির টেন্ডার (দরপত্র) কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এতে বেশির ভাগ বই ছাপানোর কাজ পাচ্ছে বিগত আওয়ামী আমলের দুর্নীতিবাজ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। সিন্ডিকেট করে দরপত্রে অংশ নিয়ে এক-তৃতীংশের বেশি কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে তারা। এনসিটিবি অনলাইনে দরপত্র আহ্বান করায় এসব বিতর্কিত সিন্ডিকেটকে কাজ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩০ ভাগ নিম্নমানের বই দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং পুরস্কার হিসাবে এবারও বেশির ভাগ বই ছাপানোর কাজ পাচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার কাজ প্রায় সোয়া ২০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে আওয়ামী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণাধীন কাউসার উজ-জামান রুবেলের অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেস পেয়েছে ৩০ কোটি ৩৪ লাখ ৯১ হাজার ২৩১ কোটি টাকার কাজ। আর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাই রাব্বানি জব্বারের আনন্দ প্রিন্টার্স পেয়েছে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ১৬৭ টাকার কাজ। এছাড়া দুলাল সরকারের মালিকানাধীন সরকার প্রেস, অনন্যা প্রিন্টার্স ও বলাকা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স পেয়েছে ২১ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ৩০২ কোটি টাকার কাজ। আর এসএম মহসীনের প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স পেয়েছে ১২ কোটি ১৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকার কাজ। মোট ৩০ কোটি বইয়ের মধ্যে ১০ কোটির বেশি বই ছাপানোর কাজ পাচ্ছে আওয়ামী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে বেশিরভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বিগত শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের বই ছাপিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই নিয়ে ২৪ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এনসিটিবির কাছে তাদের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। ২০ জুলাই অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেসের মালিককে দুদক তলব করেছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক সাহতাব উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বই ছাপানোর কাজের স্বচ্ছতার জন্য আমরা অনলাইনে দরপত্র আহ্বান করেছি। এখানে যে প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দর দেবে তাদের কাজ দেওয়া হয়। এতে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান গতবার নিম্নমানের বই ছাপিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সরকার প্রেসের মালিক দুলাল সরকার যুগান্তরকে বলেন, আমি সব সময় ভালো বই দেওয়ার চেষ্টা করি। দুদকের তালিকায় নাম থাকার বিষয়কে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তিনি। সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মুদ্রণ শিল্প সমিতির কোনো নেতা নই। তবে সিন্ডিকেটের একজন সদস্য। এই সিন্ডিকেটে অনেকেই আছেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রায় ৯ কোটি ও মাধ্যমিকের প্রায় ২১ কোটি বই ছাপানো হবে। এজন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ছাপাতে প্রায় ১ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা ও প্রাথমিকের জন্য প্রায় ৪২৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার দরপত্র সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও এই সিন্ডিকেট বেশি কাজ পেয়েছে। আর ২৪ জুলাই নবম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে। এ বছর পাঠ্যবই ছাপায় কাজ করছে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান।
এদিকে সদস্যদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ও নানা আইনি তৎপরতার পর অবশেষে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন উপসচিবকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের সিন্ডিকেট ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলেও এনসিটিবির আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ তাদের হাতেই রয়ে গেছে।
মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত; সেহেতু, বাণিজ্য সংগঠন আইন, ২০২২ এর ১৭ ধারা মোতাবেক সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিলপূর্বক সরকারের অনুমোদনক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সন্দ্বীপ কুমার সরকারকে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করা হলো। তিনি ১২০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন ও দায়িত্ব হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।
জানা যায়, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই রাব্বানি জব্বার সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ২০২১ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যানের পদও অনেকটা জোর করে দখলে নিয়েছেন। গত ১৫ বছর এনসিটিবির বই ছাপায় একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল তার।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার পিওন জাহাঙ্গীরের ছত্রছায়ায় চলতেন কাউসার-উজ-জামান রুবেল। দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীর এনসিটিবির কাজ নিয়ন্ত্রন করতেন। মুদ্রণ সমিতির গত নির্বাচনে জাহাঙ্গীর সরাসরি হস্তক্ষেপ করে রুবেলকে সেক্রেটারি বানিয়েছে। দীপু মনি ও নওফেলের সঙ্গেও ছিল রুবেলের দারুণ সখ্য। তিনিই মূলত রাব্বানি জব্বারের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী আমলে অনেকটা গায়ের জোরে সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন তারা।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১১৬টি প্রেস বই ছাপার কাজ পায়। এরমধ্যে মাধ্যমিক স্তরে ইন্সেপকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে ২৯টি প্রেস নিম্নমানের বই দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এর বাইরে সৃষ্টি প্রিন্টার্স, কচুয়া প্রেস, অগ্রণী প্রিন্টার্স, সরকার প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন ও কর্ণফুলী প্রিন্টার্সসহ আরও কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিম্নমানের বই ছাপানোর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এজেন্সির রিপোর্টে অদৃশ্য কারণে তাদের নাম বাদ পড়েছে। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে নিম্নমানের বই ছাপানোর দায়ে ৪৮ প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এলে সেখানে উল্লিখিত কয়েকটি প্রেসের নাম নেই।
