মুচলেকায় মুক্ত বরিশালে আটক দুই সমন্বয়ক
আমুর কর্মচারী শাওনের ৩ কোটি টাকার বিল ছাড়ানোর চেষ্টা
বরিশাল ব্যুরো ও ঝালকাঠী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর কর্মচারী শাওন খানের ৩ কোটি টাকার ঠিকাদারি বিল ছাড়াতে গিয়ে আটক হয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সমন্বয়ক। পরে লিখিত মুচলেকা রেখে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঝালকাঠির স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। আটক সমন্বয়করা অবশ্য দাবি করেছেন যে, উন্নয়ন কাজে অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করতে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। সে সময় স্থানীয় ঠিকাদাররা পরিকল্পিত মব সৃষ্টি করে তাদের থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
দুই সমন্বয়ক হলেন, সদ্য বিলুপ্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব, আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম (২৪) এবং বরিশাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সেমিস্টারের ছাত্র মো. মেহেদী (২৫)।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বর্তমানে কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর কম্পিউটার অপারেটর শাওন খান ফ্যাসিস্ট আমলের একজন ঠিকাদার। ক্ষমতা থাকাকালে কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করা এই শাওনের সড়ক ও সেতু নির্মাণ বাবদ ৩ কোটি টাকার বিল পাওনা রয়েছে এলজিইডি দপ্তরে। ‘বাদল কনস্ট্রাকশন’ নামে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিপরীতে কাজটি করেন শাওন। প্রায় দুই মাস যাবৎ বরিশালের ওই দুই সমন্বয়ক বিলগুলো পরিশোধের জন্য নলছিটি উপজেলা প্রকৌশলীকে চাপ দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তারা বিল ছাড়ানোর বিনিময়ে উপজেলা প্রকৌশলীকে ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রাজি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার তারা গিয়ে হাজির হন নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে। বিল প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু এবং টাকা দেওয়ার জন্য তারা চাপ দেন নির্বাহী প্রকৌশলীকে। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে ভিড় জমান অন্য ঠিকাদাররা। বিল বকেয়া থাকা ঠিকাদাররা তাদের বিল না দিয়ে ফ্যাসিস্ট আমলের কোনো নেতার বিল দেওয়া যাবে না বলে প্রতিবাদ জানালে তর্কে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। একপর্যায়ে আরও লোকজন জড়ো হলে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিষয়টি জানানো হয় স্থানীয় থানায়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে ওই দুই সমন্বয়ককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
ঝালকাঠি সদর থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক আটক হয়েছেন- এমন খবর পেয়ে আমরা এলজিইডি দপ্তরে পুলিশ পাঠাই। তাছাড়া এলজিইডির পক্ষ থেকেও জানানো হয় যে দুই সমন্বয়ক তাদের অনৈতিক দাবি আদায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি করছেন। বিল নিয়ে তাদের সঙ্গে নাকি সাধারণ ঠিকাদারদেরও ঝামেলা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী দুজনকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসা হয়। তবে এ ব্যাপারে কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ না দেওয়ায় রাত ৯টা নাগাদ লিখিত মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়।’ পরিচয় না প্রকাশের শর্তে থানা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, দুই সমন্বয়ককে থানায় আনার পর রাতে সেখানে যান ঝালকাঠি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান মুবিন, বরিশাল জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম এবং বরিশাল মহানগর এনসিপির সংগঠক তুষার খানসহ অন্য নেতারা। তাদের সামনে এলজিইডি দপ্তরে যাওয়া ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেন সিরাজ ও মেহেদী। ভবিষ্যতে এমনটা আর হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। পরে উভয় পক্ষ ‘বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি’ এমনটা লিখে কাগজে স্বাক্ষর করেন। এরপর দুই সমন্বয়ককে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নলছিটি উপজেলা প্রকৌশলী ইকবাল কবীর বলেন, বরিশালের দুই সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর স্টাফ শাওনের পক্ষে ৩ কোটি টাকার একটি কাজের চূড়ান্ত বিল ছাড়িয়ে নিতে আসে। কাজ শেষ না হওয়া এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিল না করায় প্রকৃত ঠিকাদারকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দপ্তরে আসতে বলি। প্রকৃত ঠিকাদার না এনে তারা কিছু ছেলেপেলে নিয়ে বারবার এসে বিল দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের বিষয়টি জানিয়েছি। ঠিকাদার ছাড়া কিভাবে বিল দেব? একপর্যায়ে তারা বিল দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। রাজি না হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করে আসছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় দুই সমন্বয়ক দাবি করেন, ‘নলছিটির উপজেলা প্রকৌশলী ইকবাল কবীরের ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করতে গিয়েছিলাম। এ সময় পরিকল্পিতভাবে মব সৃষ্টি করে আমাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে অভিযোগের প্রমাণ না পেয়ে পুলিশ আমাদেরকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে।’
