রাজশাহীতে যৌথ বাহিনীর অভিযান
কোচিং সেন্টার থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার
কোচিং সেন্টারের মালিক অনিন্দ্যসহ আটক ৩
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী মহানগরীর কাদিরগঞ্জ মহল্লার একটি কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে কিছু অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর একটি দল। এ সময় ‘ডক্টরস ইংলিশ’ নামের কোচিং সেন্টারটির মালিক ও পরিচালক মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্য (৩৬) এবং সন্দেহভাজন হিসাবে ফয়সাল ও রবিন নামে দুজনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। অনিন্দ্য রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের চাচাত ভাই। তবে তার বাবা শফিউল আলম লাটকু রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি।
রাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৬ সালের ২ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশ অনিন্দ্যকে গ্রেফতার করেছিল। সে সময় কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনিন্দ্য রাবির ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।
জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত হয়ে দেশের ভেতরে কয়েকটি হামলায় অংশ নিয়েছিল বলে ওই সময় পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন তিনি। গুলশানের চাঞ্চল্যকর হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার ঘটনার তদন্তেও অনিন্দ্যের সম্পৃক্ততা পায় গোয়েন্দা পুলিশ। ওই সময় তাকে রাজশাহী থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। আরও অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মেয়র লিটনের আত্মীয় হওয়ায় ওই সময় সব মামলা ও অভিযোগ থেকে পুলিশ অনিন্দ্যের নাম বাদ দিয়েছিল।
গত কয়েক বছর ধরে অনিন্দ্য নিজের বাড়ির লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় টিনশেড দিয়ে এই কোচিং সেন্টারটি পরিচালনা করছিলেন। পাশাপাশি গোপনে অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুত ও তৈরির কাজও করে আসছিলেন। যৌথ বাহিনী গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার মধ্যরাতে অভিযান শুরু করে।
এদিকে শনিবার বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো সেনাবাহিনীর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অভিযানে ‘ডক্টরস ইংলিশ’ নামের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি, সামরিক মানের দুরবিন ও স্নাইপার স্কোপ, ছয়টি দেশীয় অস্ত্র, সাতটি বিদেশি ধারালো ডেগার, পাঁচটি উন্নতমানের ওয়াকিটকি সেট, একটি সামরিক মানের জিপিএস, একটি টিজার গান, দেশি-বিদেশি কার্টিজ, বিপুল অব্যবহৃত সিমকার্ড, বিস্ফোরক বানানোর সরঞ্জামাদি, ছয়টি কম্পিউটার, বিদেশি মদ, নগদ ৭ হাজার ৪৪৫ টাকা এবং ১১টি নাইট্রোজেন কার্টিজ। নাইট্রোজেন কার্টিজগুলো বিস্ফোরকের কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় সেগুলো এরই মধ্যে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট নিষ্ক্রিয় করেছে বলেও সেনাবাহিনীর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, রাজশাহী সেনা ক্যাম্প, ৪০ ইস্ট বেঙ্গলের (মেকানাইজড) একটি চৌকস দল অন্যদের সঙ্গে এই বিশেষ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুত এবং তৈরির অভিযোগে কোচিং পরিচালক অনিন্দ্য এবং সন্দেহভাজনভাবে ফয়সাল ও রবিন নামের আরও দুজনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর আরও অস্ত্রের খোঁজে কাদিরগঞ্জে অনিন্দ্যদের বাড়িসংলগ্ন পুকুরটিতে তল্লাশি চলমান রয়েছে। এ কাজে সহায়তা করছে রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরিদের একটি দল। অভিযানে পুলিশ তাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এই অভিযানের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টিও চলমান রয়েছে বলে সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
কে এই অনিন্দ্য : মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্য রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শফিউল আলম লাটকুর ছেলে। লাটকু রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের চাচা। কাদিরগঞ্জের যে বাড়িটিতে অনিন্দ্যরা বসবাস করেন সেখানেই খায়রুজ্জামান লিটনের পৈতৃক বাড়ি। তবে স্থানীয়রা জানান, খায়রুজ্জামান লিটনের বাবা এএইচএম কামারুজ্জামান পারিবারিকভাবে এই বাড়িতে বসবাস করলেও লিটন কখনো এই বাড়িতে ছিলেন না।
পারিবারিকভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনিন্দ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির পর বছর দুয়েক ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পরে হঠাৎ করেই রাবি শাখা ছাত্রলীগের আহমদ-বিপু কমিটিতে অ্যাপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়ে যান। তাকে ছাত্রলীগে পদ দেওয়ার পেছনে তার চাচাত ভাই লিটনের প্রভাবকেই দায়ী করেন ওই সময়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অনিন্দ্যকে প্রায়ই দেখা যেত তার সহপাঠি শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। শরিফুল ইসলামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়।
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে নগরীর শালবাগান এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় রাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। অধ্যাপক সিদ্দিকী খুনে একই বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলামকে সন্দেহ করে তার পরিবার। কারণ শরিফুল তার শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। রেজাউল করিম সিদ্দিকীর বাড়িও রাজশাহীর বাগমারার একই এলাকায়। অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যা মামলা তদন্তে নেমে গোয়েন্দা পুলিশ প্রথমে শরিফুল ও পরে তার সহপাঠি অনিন্দ্যের সম্পৃক্ততা পায়। শরিফুল পলাতক থাকলেও পুলিশ ২০১৬ সালের ২ জুলাই অনিন্দ্যকে গ্রেফতার করে। তিন দফা রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনিন্দ্য অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যায় নিজের ও শরিফুলের সম্পৃক্তার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। এরপর দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন।
পরবর্তীতে অনিন্দ্যকে অধ্যাপক রেজাউল করিম ও হলি আর্টিজান মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অনেকেই ধারণা করেন, রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লিটনের প্রভাবে পুলিশ তাকে দুটি চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে আরএমপির কুইক রেসপন্স টিমও কাজ করেছে। বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলমান আছে। তবে অভিযান পুরোপুরি শেষ হয়নি। গ্রেফতারদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
