ক্রেডিট কার্ডে গলাকাটা সার্ভিস চার্জ
ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি বাদ দিয়ে শুধু একটি কার্ড সঙ্গে রেখে যে কোনো পণ্য বা সেবা কেনাকাটা বা বিল পরিশোধ করা সহজ। আর সরকারও চাচ্ছে নগদের পরিবর্তে অনলাইন লেনদেন বাড়াতে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে ক্রেডিট কার্ড। এতে সরকারের টাকা ছাপানোর খরচ কমে যাবে। প্রতিবেদন তৈরি করেছেন হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মোস্তাফিজুর রহমান একজন চাকরিজীবী। বেতনের টাকায় সংসারের পুরোমাসের খরচ চালাতে পারেন না। বাধ্য হয়ে ধার করতে হয়। আগে বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার করতেন। এখন আর তা করেন না। ব্যাংকই এখন তার কাছে টাকা নিয়ে হাজির হয়েছে। নিয়েছেন একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড। মাস শেষে টাকার প্রয়োজন হলে এখান থেকে তুলে নেন। আবার বেতন পাওয়ার পর তা পরিশোধ করে দেন।
রেহানা আফরোজ চাকরি করেন একটি বিদেশি সংস্থায়। অফিস থেকে ফেরার পথে সংসারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটাগুলো নিজেই করে নেন। এ কাজে নগদ টাকার চেয়ে ক্রেডিট কার্ডকেই তিনি বেশি পছন্দ করেন।
ক্রেডিট কার্ডের কারণে জীবনযাপনের অনেক উপকরণই এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে কার্ডের সেবার বিপরীতে ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত সুদ ও সার্ভিস চার্জ আদায় নিয়ে। অনেকেই এ অতি প্রয়োজনীয় সেবার বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত ফি ও চার্জ নিয়ে গ্রাহকের গলাকাটা হচ্ছে বলে মনে করেন। এতে টাকা নেয়ার খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যা বিশেষ করে তাদের মতো মধ্যবিত্তের পক্ষে বহন করা বেশ কঠিন। তারপরেও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। প্রায় সবগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এখন ক্রেডিট কার্ড সেবা নিয়ে আসছে। বিভিন্ন শপিংমল, বড় বড় শোরুম, হোটেল রেস্টুরেন্ট, হাসপাতালে এখন ক্রেডিট কার্ডে বিল পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডে ৪২ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৩টি লেনদেনের বিপরীতে টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ায় ব্যাংকগুলোও এটিকে তাদের বাড়তি আয়ের সেবা হিসেবে বেছে দিয়েছে। এজন্য এ সেবার ওপর তারা নানা ধরনের ফি ও চার্জ আরোপ করছে। আদায় করছে বাড়তি সুদ। এ বিষয়ে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে প্রায়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নানা অভিযোগ আসছে। এগুলো তদন্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সত্যতাও পাচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় এ খাতে হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে এ খাতে সুদের হার বেঁধে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের সর্বোচ্চ সুদের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি সুদ এ খাতে নিতে পারবে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংকের কোনো ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদ ১৮ শতাংশ হলে তারা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে নিতে পারবে সর্বোচ্চ ২৩ শতাংশ। কোনোক্রমেই এর বেশি সুদ দিতে পারবে না। আর ব্যাংকগুলো ঘোষিত সর্বোচ্চ সুদের হার ১৮ শতাংশ। এর বেশি নেয়ার কোনো সুযোগও নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা মানছে না। তারা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ২৭ থেকে ৩২ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে আরও ২০ ধরনের চার্জ ও কমিশন। এগুলো মিলে সুদের হার গড়ে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। অর্থাৎ ১০০ টাকা খরচ করলে ৪০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। টাকা খরচের ৩০ বা ৪০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করে দিলে কোনো সুদ দিতে হয় না বলে ব্যাংকের যে প্রচারণা রয়েছে সেগুলোতেও আছে শুভংকরের ফাঁকি। ফলে ক্রেডিট কার্ড সেবা নিতে ব্যাংকের সুদ ও চার্জ থেকে গ্রাহকরা কোনো বাড়তি ছাড় পাচ্ছেন না।
এদিকে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে আগ্রাসীভাবে সুদ আদায় করায় ১৮ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৮ জুন ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি পাঠিয়ে এ ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- এনসিসি, এনআরবি কমার্শিয়াল, ওয়ান, প্রাইম, ন্যাশনাল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, স্ট্যান্ডার্ড, ইউসিবি, ঢাকা, ইস্টার্ন, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, প্রিমিয়ার, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন এবং মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এছাড়া একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে এ তালিকায়। এ ব্যাংকগুলো অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ৮ থেকে ১৬ শতাংশ বেশি সুদ আদায় করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্রেডিট কার্ডের সেবার বিপরীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগ্রাসী সুদ আদায় করছে অধিকাংশ ব্যাংক। গত এপ্রিলের হিসাবে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৮.৫ থেকে ৩১.৫ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ৩০ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ৩০ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল ১৬ থেকে ৩০ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক ২৭ শতাংশ এবং ব্র্যাক ব্যাংক ২৪ থেকে ২৭ শতাংশ সুদ আদায় করেছে। এর বাইরেও আছে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন।
এ বিষয়ে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এসএম মাসরুর আরেফিন যুগান্তরকে বলেন, সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে তারা সীমার মধ্যেই রয়েছেন। ক্রেডিট কার্ড সেবার খরচ বেশি থাকার কারণে এ খাতে সুদের হারও বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ আদায় করে। এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ডে প্রাথমিক খরচ বাবদ দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, বার্ষিক ফি ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, কার্ড পুনঃস্থাপন ফি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা, বিলম্বে পরিশোধ ফি ৩০০ থেকে ৭৫০ টাকা, অতিরিক্ত সীমা ফি ৪৫০ থেকে এক হাজার টাকা, চেক বা অটো ডেবিট রিটার্ন ফি ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা, ডুপ্লিকেট স্ট্যাটমেন্ট ফি ১০০ টাকা, চার্জ স্লিপ রিট্রায়েভাল ফি ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা, পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি ৩০০ টাকা, সিআইবি প্রসেসিং ফি ১০০ টাকা, এনওসি সার্টিফিকেট চার্জ ৫০০ টাকা, একসেস টু এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ফি ২ হাজার টাকা, কার্ড চেক ফি ২৫০ টাকা, চেক প্রসেসিং ফি কার্ড চেকের মূল টাকার ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এসএমএস ব্যাংকিং ফি বছরে ২০০ টাকা, ফিন্যান্স চার্জেজ প্রতি মাসে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, নগদ ঋণ ফি অন্যান্য এটিএম খরচের ৩ শতাংশ, ইন্স্যুরেন্স ফি শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ, প্রিন্টেড স্ট্যাটমেন্ট ফি ৫০ টাকা এবং প্রিওরিটি পাস রি-ইস্যু বাবদ ৫০০ টাকা ফি কাটা হয়। পুরো খরচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতের ভ্যাটও পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অন্তত ১৮টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা লংঘন করে সুদ আদায় করছে। তবে ক্রেডিট কার্ড আছে এমন ৩২টি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টি ব্যাংক নীতিমালা অনুসারে সুদ হার কমিয়েছে।
