মানে প্রশ্নবিদ্ধ জিডিপি প্রবৃদ্ধি
গত ১৬ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে গড়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার বলছে, বৃত্ত ভেঙে রেকর্ড গড়ছে প্রবৃদ্ধি। অপরদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হলেও আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কমছে না দারিদ্র্যের হারও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু সরকারি হিসাবে অর্জন হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
স্বাভাবিক নিয়মে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির মানে হল মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। এতে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের আয় বাড়ে অপরদিকে দারিদ্র্যের হার কমে। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরও কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাব না পড়লে ধরে নেয়া হয় জিডিপির হিসাবে কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অথবা দেশের মানুষের আয়ে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এ রকমই বলছে।
দেশের জিডিপিতে মোটা দাগে তিনটি খাত ধরা হয়। এগুলো হল- কৃষির উৎপাদন, শিল্পের উৎপাদন এবং সেবা খাতের মোট ১৫ ধরনের সেবা। এগুলোর সম্মিলিত যোগফলকে মোট জিডিপি বলা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ পর্যন্ত অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু দারিদ্র্যের হার কমছে না। বাড়ছে না কর্মসংস্থানও। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবৃদ্ধির সুফল সমানভাবে পাচ্ছে না। এতে গ্রামের মানুষের আয়ের বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। সিপিডির এক গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, সর্বনিন্ম ৫ শতাংশ গরিব মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ, অপরদিকে ৫ শতাংশ ধনী মানুষের আয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এতে বাড়ছে সম্পদের বৈষম্য। আয় ও সম্পদ বৈষম্য বেশি হলে আগে বা পরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জিডিপির ওপর।
জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, প্রবৃদ্ধি অবশ্যই ভালো হচ্ছে। অর্থনীতি খুব ভালো গতিতে এগোচ্ছে। এরপরও গবেষক বা অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ থাকলে তারা জানাতে পারেন। তবে আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে সন্তুষ্ট। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সম্প্রতি এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেন, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এ অর্জনের বড় শক্তি হচ্ছে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবস্থান। এ অর্জনকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। আবার সব সময় তা বজায় থাকবে তাও ঠিক নয়। তিনি বলেন, এরপরও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটেনি। বিবিএসের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিগত দু’দশকের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য বিমোচন হারের গতি কমেছে। একই সঙ্গে গ্রামে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। কমেছে কর্মসংস্থানও।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০০৫- এই পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, গত ১৬ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে গড়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ৫ বছরের তুলনায় দ্বিতীয় ৫ বছরে বেড়েছে ১ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ৫ বছরের তুলনায় শেষ ৬ বছরে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০০-০৫ এই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫-২০১০ সাল এই পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। এ সময় কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ৭ শতাংশ। একইভাবে ২০১০-২০১৬ সালে এই সময়ে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি আরও কমে যায়। এই ৬ বছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে গত ১৬ বছরে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ৫ বছরের তুলনায় দ্বিতীয় ৫ বছরে কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ৫ বছরের তুলনায় শেষ ৬ বছরে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের গতি হার অনুযায়ী, এই একই সময়কালে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০০-০৫ এই পাঁচ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের গতির প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৫-১০ সাল, এই পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। এ সময় দারিদ্র্য বিমোচনের গড় প্রবৃদ্ধি হয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ। একইভাবে ২০১০-১৬ সালে এই সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধি আরও কমে যায়। এই ৬ বছরে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে গত ১৬ বছরে দেশের ভেতর দারিদ্র্য বিমোচনের গতির হার কমেছে দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ৫ বছরের তুলনায় দ্বিতীয় ৫ বছরে কমেছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ৫ বছরের তুলনায় শেষ ৬ বছরে গতির প্রবৃদ্ধির হার গড়ে দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি সিপিডির অর্থনৈতিক পর্যালোচনা রিপোর্টে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গুণগত মান কমছে। এই প্রবৃদ্ধি যে পরিমাণ গরিব মানুষকে নিচ থেকে তুলে আনার কথা তা পারেনি। এটি নিয়ে চিন্তার কারণ হচ্ছে একটি দেশে ক্রমান্বয়ে আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়লে আগে বা পরে প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ বৈষম্য বেশি হলে প্রবৃদ্ধির হার উচ্চদিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানোর কৌশল রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দ্বিতীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো এবং তৃতীয় হচ্ছে দারিদ্র্যের হার কমানো। এই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে দারিদ্র্যে হার আশানুরূপ কমছে না।
