Logo
Logo
×

অর্থনীতি

সরকারের এক বছর

অর্থনীতির ক্ষত চিহ্নিত

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাস বদলে দেওয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়েছে। এ রকম একটি অভ্যুত্থানের পর সরকারের সামনে মোটাদাগে চ্যালেঞ্জ ছিল চারটি। এর মধ্যে রয়েছে-স্থিতিশীলতা ফেরানো, রাষ্ট্র সংস্কার, গণহত্যার বিচার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ। আবার স্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আইনশৃঙ্খলা। এ নিয়ে এক বছরে আছে সাফল্য-ব্যর্থতার নানা গল্প। তবে অর্থনীতির একজন ক্ষুদ্র শিক্ষার্থী হিসাবে আমার বিবেচনায় এই পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নয়নের মোড়কের আড়ালে থাকা অর্থনীতির ক্ষত চিহ্নিত হয়েছে। সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সে রকম পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। কারণ পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।

গত ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে দেশ থেকে টাকা পাচারের নানা তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে শুধু এগুলোকে অস্বীকার হয়নি, এর সঙ্গে জড়িতদের দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে দুর্নীতি হয়েছে-ব্যাংকিং খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে। ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিটিতে অতিরিক্ত ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যয়ের সুবিধা বিশেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে। এ সময়ে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর ১০ শতাংশ অবৈধ লেনদেন ধরা হলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে এই প্রতিবেদন সরকারি দলিল। জুলাই অভ্যুত্থান না হলে হয়তো কখনোই তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যেত না।

এক বছরে অর্থনীতিতে খুব বেশি বড় অর্জন হয়েছে, এমন নয়। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এটি সম্ভবও নয়। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার আসে সাময়িক সময়ের জন্য। তাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পলিসি থাকে না। ফলে এই সরকারের ওপর নির্ভর করে দেশে বিনিয়োগ আসেনি। ড. ইউনূসের সরকারের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটিই হয়েছে। অর্থনীতির ৯টি মৌলিক সূচকের মধ্যে বর্তমানে অধিকাংশই নেতিবাচক। বিনিয়োগ নেই, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কম, রাজস্ব আদায় নিম্নমুখীসহ নানা সংকট রয়েছে। তবে ঈর্ষণীয় অর্জন রয়েছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে। বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সার কেনার মতো ডলার ছিল না। আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। ১ ডলারের দাম ১৩০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু বর্তমানে সেখানে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন ডলারের সংকট নেই। অর্থনীতিতে বড় অর্জন হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ডাবল ডিজিট থেকে সর্বশেষ সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিদেশি যে সব দায়দেনা ছিল সব ইতোমধ্যে পরিশোধ হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ী আদানির ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে একদিনে পরিশোধ করেছে ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার। শেভরনের ২৩৭ মিলিয়ন ডলার একদিনে পরিশোধ করা হয়েছে। মুনাফার অর্থ নিজ দেশে নিতে না পারায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ওই সময়ে ব্যবসা বন্ধ করতে চেয়েছিল। মুনাফা আটকে ছিল অন্য বিদেশি কোম্পানি-মেটলাইফ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো এবং গ্রামীণফোনসহ সব প্রতিষ্ঠানের। সেগুলো পরিশোধ হয়েছে। অর্থাৎ এতটুকু বলা যায়, বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। অর্থ সংগ্রহের সব খাত দুর্বল। ব্যাংকিং খাতে ক্যানসার। খেলাপি ঋণ ইতোমধ্যে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ১শ ঋণখেলাপির কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে অন্তত ৫টি মেট্রোরেল করা সম্ভব। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার হাহাকার। তারা আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছে না। তারল্য ঘাটতি রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করাতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের অধীনে ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূলধন সংগ্রহের আরেক খাত শেয়ারবাজার। বর্তমানে শেয়ারবাজার লাইফ সাপোর্টে আছে। তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কোম্পানি লোকসানে। ৫ আগস্টের পর বাজার সংস্কারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্ব বদল করেছে সরকার। কিন্তু নতুন নেতৃত্বের দক্ষতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

তবে এত সমস্যার মধ্যেও আশার আলো আছে। বর্তমান সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপে বন্ধ হয়েছে ব্যাংক খাতে নতুন লুটপাট। ব্যাংকগুলোকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রবণতাও বাতিল করা হয়েছে। পাচার করা টাকা উদ্ধারে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দেশে ও বিদেশে কয়েকজন পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধার করার জন্য নেওয়া হয়েছে বহুমুখী কার্যক্রম। যদিও এর সুফল আসতে একটু সময় লাগবে। ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি বিশেষায়িত টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কার টাস্কফোর্স প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী করা, সম্পদের মান উন্নত করা এবং কার্যকর ব্যাংক ব্যবস্থা গঠনের জন্য একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ মাসে ব্যাংক খাত পুনর্গঠন এবং সমস্যা সমাধানে একটি ইউনিট গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বাড়ানো এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে দ্বিতীয় টাস্কফোর্সটি। তৃতীয় টাস্কফোর্সটি বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদ চিহ্নিত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। এ কাজের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সাড়ে ৬ হাজারের বেশি সন্দেহজনক ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। অর্থাৎ রোগ সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন চিকিৎসা শুরুর পালা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম