ভাসমান অপরাধী দমন
পুলিশের কর্মপদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন কাম্য
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে রোমহর্ষক সব অপরাধের ঘটনা, যা গণমাধ্যমে নিয়মিতই স্থান পাচ্ছে। এসব ঘটনায় জনমনে প্রশ্ন জাগছে, দেশে আদৌ কি জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? বস্তুত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা পুলিশের দায়িত্ব এবং সব সময়ই এটি তাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই চ্যালেঞ্জের মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে ভাসমান অপরাধী গোষ্ঠী, যাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, যারা এক এলাকায় অপরাধ করে অন্য এলাকায় দ্রুত গা-ঢাকা দেয়। এ ধরনের অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা পুলিশের জন্য রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাসমান অপরাধীরা শুধু ছিনতাই, চুরি বা মাদক কারবারে সীমাবদ্ধ নেই; বরং হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে; টাকার বিনিময়ে ভাড়াও খাটছে, অংশ নিচ্ছে টার্গেট কিলিংয়ে, যা জনমনে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে।
ভাসমান অপরাধীদের শনাক্ত করতে পুলিশের হিমশিম খাওয়ার মূল কারণগুলোর অন্যতম এ অপরাধীদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা না থাকা। তাছাড়া তাদের বেশির ভাগরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। যেহেতু তাদের কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান বা পরিচয়পত্র থাকে না, অপরাধের পর তারা সহজেই জনসমুদ্রে মিশে যেতে পারে। ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় কিছু রাজনৈতিক নেতা বা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন, যা তাদের আইনের আওতায় আনা আরও কঠিন করে তোলে।
এছাড়া অপরাধীরা দ্রুত স্থান পরিবর্তন করায় প্রচলিত পুলিশিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের ওপর নজরদারি করা প্রায় অসম্ভব। তাই এ সমস্যা মোকাবিলায় পুলিশের কর্মপদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করি আমরা। এক্ষেত্রে শুধু দমনমূলক কৌশল নয়, একটি সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, প্রতিটি থানাকে তার আওতাধীন ভাসমান জনগোষ্ঠীর একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে। এতে তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য, ছবি এবং অপরাধপ্রবণতা সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
প্রতিটি এলাকাকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ, উন্নত গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা। যেসব এলাকায় ভাসমানদের আনাগোনা বেশি, সেসব এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন করে নজরদারি বাড়াতে হবে।
তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য ভাসমান মানুষের সামাজিক পুনর্বাসন এবং তাদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মাদকের সহজলভ্যতা-অপরাধের এই মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে শুধু পুলিশি অভিযান দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না।
জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভাসমান অপরাধীদের দমনে পুলিশকে আরও কৌশলী, সক্রিয় ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। সেই সঙ্গে এই বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সামাজিক দায়িত্ব পালনও অপরিহার্য। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকার নতুন নতুন কৌশল ও সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে, এটাই প্রত্যাশা।
