Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

রক্তে লেখা ফুলবাড়ী

Icon

প্লাবন শুভ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রক্তে লেখা ফুলবাড়ী

২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা পাবর্তীপুর, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ থেকে আসা মানুষের ঢলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় ফুলবাড়ী। দিনটি ছিল শনিবার।

চারদিকের দোকানপাটসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ ছুটছিল দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের নিমতলা মোড়ের দিকে। যে যার মতো লাঠিসোটা নিয়ে ছুটছিল। আমিও কৌতূহলী হই। আমারও প্রবল আগ্রহ হয় তাদের সঙ্গ দেয়ার।

কিন্তু বয়স কম হওয়ায় সম্ভব হয়নি। পরিবার থেকে বাধার সম্মুখীন হই। না যেতে পারায় বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মানুষ কীভাবে জন্মভূমি রক্ষার্থে ছুটছে। তারা ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি না করার দাবি জানাচ্ছিল।

২০০৬ সালে ফুলবাড়ীর ১৪ হাজার একর ফসলি জমিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। ফুলবাড়ী প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ২০০৬ সালের ২৩-২৫ মার্চ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি প্রথম বড় কর্মসূচি গ্রহণ করে, ঢাকা থেকে ফুলবাড়ী রোড মার্চ। পথিমধ্যে ১৩টি স্থানে সমাবেশ ও গণসংযোগের মাধ্যমে মানুষকে ফুলবাড়ী সম্পর্কে জানানো হয়।

২৬ আগস্ট জাতীয় কমিটি ও ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটির উদ্যোগে বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হয়। ওই দিন দুপুর ২টার দিকে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল নিমতলা মোড়ের দিকে এগোতে থাকলে প্রথমে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের বাধায় বিশাল মিছিলটি জঙ্গিরূপ ধারণ করে।

মিছিলটি পুলিশ-বিডিআরের ব্যারিকেড ভেঙে এগোতে থাকলে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। জানমাল রক্ষার্থে যে যেভাবে পারে মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি, টিয়ারগ্যাস ও লাঠি চার্জ করে তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশ সদস্যরা।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তাতেই পড়ে থাকে কলেজ শিক্ষার্থী আমিন, সালেকিন ও তরিকুলের নিথর দেহ। আহত হন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। জারি হয় ১৪৪ ধারা। রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে পড়ে। শুধু দেখা যাচ্ছিল বিডিআর ও পুলিশ সদস্যদের। দোকানপাট বন্ধ।

২৬ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত জনতার আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল ছিল পুরো ফুলবাড়ী খনি এলাকা। রাস্তাঘাটে জ্বলছিল টায়ার। কালো ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ সবত্র। গাছের গুড়ি রাস্তায় বিছানো। যানবাহন চলাচল নেই, আছে শুধু বিডিআর ও পুলিশের গাড়ির টহল। আমার বাসাটা ফুলবাড়ীর প্রাণকেন্দ্র কালীবাড়ী বাজারসংলগ্ন হওয়ায় জানালা খুলে দেখি শুধুই পুলিশ আর বিডিআরের গাড়িগুলো যাতায়াত করছে। রাতভর চলে গাড়ির সাইরেন।

৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে পার্বতীপুর উপজেলা অডিটরিয়ামে সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের ছয় দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সরকার ছয় দফা চুক্তির আংশিক বাস্তবায়ন করে।

৪ সেপ্টেম্বর ফুলবাড়ী সরকারি কলেজ মাঠে ১৪ দল আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেশের সম্পদ রক্ষায় ফুলবাড়ীবাসী যে আত্মত্যাগ করেছেন তা ইতিহাসে লেখা থাকবে।

এ বীরত্বপূর্ণ ত্যাগের জন্য ফুলবাড়ীসহ সংশ্লিষ্ট চার উপজেলার নারী-পুরুষদের ধন্যবাদ জানান তিনি। এর আগে আন্দোলনে প্রাণ হারানো আমিন, সালেকিন ও তরিকুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান তিনি।

২৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবুল রায়ের মতো অনেকেই পঙ্গুত্বের অসহনীয় জ্বালা-যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনও। যন্ত্রণা নিয়ে পরলোকগমন করেছেন প্রদীপ সরকার।

প্লাবন শুভ : গণমাধ্যমকর্মী, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর

shuvo.phulbari@gmail.com

 

ফুলবাড়ী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম