মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামীকরণ প্রকল্প
ভুয়া গবেষকদের আইনের আওতায় আনতে হবে
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিগত সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ নামে ২৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। রোববার যুগান্তরের খবরে প্রকাশ, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রীতিমতো লুটপাট করেছেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা। জানা গেছে, নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন না করেই সাড়ে ২৩ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে ১৩ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) পর্যালোচনা কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে। যেসব আওয়ামী বুদ্ধিজীবীর প্রতিষ্ঠান নামমাত্র গবেষণা করে অর্থ তুলে নিয়েছে, সেগুলো হলো-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামালের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসাইনের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানের উন্নয়ন সমন্বয়, অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুনের গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. এমরান জাহানের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পার্লামেন্টারি স্টাডিজ এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েকুজ্জামানের প্রতিষ্ঠান প্রাগমেটিক কনসালটেন্সি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।
প্রতিবেদন থেকে বোঝাই যাচ্ছে, কাজ না করে হরিলুট করতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের নামে যেনতেন গবেষণা আর দলীয় প্রভাবে টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। আশার কথা, বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে হাবিবুল আলম বীরপ্রতীককে আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে জামুকা। পর্যালোচনা কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে এ কার্যক্রম অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত ও নতুন নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করা; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়নি। বরং এসব গবেষণার অধিকাংশই পূর্বের কোনো তথ্য থেকে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। দেখা গেছে, এতে গবেষকরা নিজেদের ইতঃপূর্বে প্রকাশিত তথ্য ও লেখা অধিকমাত্রায় আবার প্রতিস্থাপন করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে ইতিহাসের অনেক সত্যকে তো বাদ দেওয়া হয়েছেই, এসব গবেষণায় শুধু ব্যক্তি ও সুনির্দিষ্ট একটি দলকে গুরুত্ব দিয়ে করা হয়েছে।
বস্তুত, প্রকল্পের নামে সারা দেশে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, দলীয়করণ হয়েছে এটি তারই অংশ। তদন্ত প্রতিবেদনে সত্যতা নিশ্চিত হলে জড়িতদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। ভুলে গেলে চলবে না, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রামে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে বারবার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিশেষ দল ও ব্যক্তির হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই প্রকল্পটিও যে সেটিই বাস্তবায়নের হীন উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তা পরিষ্কার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো দল বা ব্যক্তির একক সংগ্রাম ছিল না। এ যুদ্ধে পুরো বাঙালি জাতি অবদান রেখেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। পরিতাপের বিষয়, অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এসব বুদ্ধিজীবীকে আইনের আওতায় আনা যথার্থ হবে বলে মনে করি আমরা।
