ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা
শান্তি ফেরাতে আন্তর্জাতিক মহলকে উদ্যোগী হতে হবে
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শান্তিদূতের মুখোশের আড়ালে ঢাকা ‘মধ্যপ্রাচ্যের অসুরে’র মুখই কি দেখল বিশ্ববাসী? ইরানে ইসরাইলি বাহিনীর সামরিক আগ্রাসনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি পুনরুদ্ধারে দুই সপ্তাহের সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু দুদিন না যেতেই রোববার তিনি হামলা চালালেন ইরানে। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের অতর্কিত সামরিক হামলা যে সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সুস্পষ্ট আঘাত, তা বলাই বাহুল্য।
জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার আগে ইরানের দিক থেকে এমন কোনো সরাসরি সামরিক হুমকি আসেনি, যা এ ধরনের আক্রমণকে আত্মরক্ষামূলক বলে আখ্যায়িত করতে পারে। কাজেই ওয়াশিংটনের এ আচরণ যে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষে তেল আবিবের হয়ে ওয়াশিংটনের অন্যায় হস্তক্ষেপ স্বভাবতই মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে মনে করি আমরা। এর আগে পারমাণবিক কর্মসূচি, সিরিয়া-লেবাননে মিলিশিয়া সমর্থন এবং জেরুজালেম ইস্যুতে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে বৈরিতা বৃদ্ধি পেতে আমরা দেখেছি; কিন্তু ইরানের ওপর তেল আবিবের সামরিক আগ্রাসন ছিল অকল্পনীয়। সেই অবৈধ আগ্রাসনেই শামিল হলো যুক্তরাষ্ট্র, যা সারা বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক।
কালের পরিক্রমায় সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সমরাঙ্গনের কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে; ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সাইবার যুদ্ধ কিংবা গোয়েন্দা লড়াই আরও জটিল মাত্রা পেয়েছে। লেবাননে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের পেজার হামলা কিংবা ইরানের অভ্যন্তরে টার্গেট করে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনা তারই প্রমাণ।
তিক্ত হলেও সত্য, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য ক্রমেই খর্ব হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো বিশ্ব দরবারে নিজেদের শক্তিমত্তার স্বরূপ প্রকাশ করছে। ফলে এটি বোঝা কঠিন নয় যে, প্রায় হাতছাড়া ‘বৈশ্বিক মোড়লে’র তকমা পুনরুদ্ধারের জন্যই ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র দেশটি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার মতো ভয়াবহ কর্মকাণ্ডটি ঘটিয়েছে।
কিন্তু ওয়াশিংটনের এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য ছিল যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এ চুক্তির অধীনে ইরান পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকারী এবং এ সংক্রান্ত নিরীক্ষার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ)। ইরানের ফর্দোসহ তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করেছে, এতে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর তা ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত। একটি দেশের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কার্যক্রমের নিরাপত্তা ও রক্ষাকবচ নিশ্চিতে এনপিটির ৪ ও ৬ অনুচ্ছেদকে অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলা এমন এক নজির গড়ল, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্বকেও নিশ্চয়ই ঝুঁকির মুখে ফেলবে। ট্রাম্প প্রশাসনের এমন আচরণের জবাব তাই জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার অবিলম্বে দেওয়া উচিত। বিনা উসকানিতে ইরানের অভ্যন্তরে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসরাইল যে উত্তেজনার বীজ বপন করেছিল, সেই উত্তেজনা প্রশমনের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ যাতে সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ না নেয়, আন্তর্জাতিক মহলকে সে চেষ্টাই করতে হবে।
