পেয়ারার ভাসমান হাট
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা, ঝালকাঠির ভিমরুলিতে বসে ভাসমান পেয়ারার হাট। তিন-চারটি খালের মোহনায় পেয়ারাভর্তি নৌকা জড়ো হয়। ভাসমান অবস্থায় পেয়ারা বিক্রি হয়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা পেয়ারা কিনে নিয়ে যান। ভাসমান এ হাটের বয়স দেড়শ বছর পেরিয়ে গেছে। পেয়ারা ছাড়া কাগজি লেবু, আমড়া, সুপারি, কলা, বোম্বাই মরিচসহ অন্য সবজিও বিক্রি হয়। বলা হয়ে থাকে, থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট, কেরালার ব্যাকওয়াটার মার্কেটের চেয়েও এখানকার ভাসমান হাট সুন্দর। জুন থেকে আগস্ট পেয়ারার মৌসুম। লাখ লাখ পর্যটক আসেন।
দুশ বছর আগের গল্প
পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল আর সতিশ চন্দ্র মন্ডল। দুজনেরই বাড়ি আন্দাকুল গ্রামে। আত্মীয়স্বজন থাকত ভারতের গয়ায়। সেখানে তাদের ভালোই যাওয়া-আসা ছিল। একবার গয়া থেকে আসার সময় পেয়ারার বীজ নিয়ে আসেন। সে বীজ রোপণ করলে চারা গাছ হয়। ওই গাছে উৎপাদিত পেয়ারা পূর্ণমন্ডলী পেয়ারা নামে পরিচিত। বলছিলেন আটঘর কুড়িয়ানার প্রবীণ পেয়ারা চাষি নরেশ মন্ডল। এটা প্রায় দুশ বছর আগের ঘটনা। এভাবেই পূর্ণ চন্দ্র মন্ডলের হাত ধরেই এ এলাকায় পেয়ারার চাষ শুরু হয়। অন্য এক বর্ণনায় কালীচরণ নামে একজনের কথা জানা যায়। তিনি ভারতের গয়া থেকে পেয়ারার চারা নিয়ে আসেন। এখানকার মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় পেয়ারাকে গইয়া বলে থাকে। প্রথমে বিচ্ছিন্নভাবে চাষবাস হলেও ১৯৪০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ শুরু হয় বলে জানা যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু। পেয়ারা বাগানগুলো কিছুটা দুর্গম এলাকায়। রাস্তাঘাট নেই। চলাচলের বাহন নৌযান। মুক্তিযোদ্ধারা মাদ্রা, আতা, জিনুহার, অশ্বথকাঠি, জামুয়া, ব্রাহ্মণকাঠি, বাউকাঠি, ভিমরুলি, জিন্দাকাঠিসহ বিভিন্ন গ্রামের পেয়ারা বাগানে ঘাঁটি গাড়েন। আটঘর কুড়িয়ানা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। পেয়ারা বাগানে বসে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতেন। প্ল্যান করে অপারেশন চালাতেন। বলছিলেন প্রবীণ মাখন লাল। তিনি জানালেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার কারণে তার মা-বাবাকে হত্যা করা হয়। পাক হানাদাররা অসংখ্য পেয়ারা বাগান ধ্বংস করে। কুড়িয়ানা বাজার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় দশ হাজার নারী পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পানির ওপর হাট
স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা, ঝালকাঠির ভিমরুলিতে খালের মোহনায় ভাসমান হাট বসে। এ এলাকায় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর-দূরান্ত থেকে চাষিরা আসে। সঙ্গে থাকে নৌকাভর্তি তাজা টসটসে পেয়ারা। জানা যায়, আটঘর কুড়িয়ানাসহ বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি সদর উপজেলার প্রায় ৩৪টি গ্রামে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। বিশ সহস্রাধিক মানুষ পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িত। খুব সকালে চাষিরা পেয়ারা পাড়েন। হাট ১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। ছোট ছোট নৌকায় করে তারা আসেন। দেখলে মনে হবে, সব যেন একজনের হাতে তৈরি, আসলে তা নয়। পেয়ারা ছাড়াও আখ, বোম্বাই মরিচ, আমড়া, কাগজি লেবু, সুপারি চাষও তারা করেন। সুশান্ত দেবনাথ, চল্লিশ বছর ধরে পেয়ারা চাষ করছেন। বংশপরম্পরায় তিনি পেয়ারা চাষি। সুশান্ত জানালেন, এ এলাকায় এমনও বাগান আছে যার বয়স দুশ বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি বলছিলেন, পর্যটকরা আগের চেয়ে বেশি আসায় তাদের কদর বেড়েছে। এলাকারও উন্নতি হয়েছে। সংরক্ষণাগার নেই। সে কারণে পেয়ারা পচে নষ্ট হয় বলে সুশান্ত জানালেন।
এ যেন মিনি সুন্দরবন
ছোট সরু খাল। জোয়ারে পানি থাকে। ভাটায় শুকিয়ে যায়। খালের চারপাশে গাছ-গাছালিতে ভরা। গাছের ফাঁক পেরিয়ে কখনো মিষ্টি রোদ পড়ে। কোথাও বা অন্ধকার। আলো-আঁধারির এ পরিবেশ যেন সুন্দরবনকেও হার মানায়। সুন্দরবনের মধ্যে যে রকম ছোট ছোট খাল, এখানকার খালগুলো সে রকমই। স্থানীয় ভাষায় একে ভারানী বলা হয়। আটঘর থেকে ভিমরুলি যেতে কয়েকটি ভারানী পেরোতে হয়। পথে গাছভর্তি কাঁচা-পাকা পেয়ারা, বোম্বাই মরিচ, আখ, শসা সব বিভিন্ন সবজির দেখা মিলবে। নৌকা-ট্রলারে বসে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এসব। ফেসবুকে আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান, ভাসমান হাটের ছবি দেখে ভালো লাগে। তাই স্বামী, সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে এসেছি। খুবই ভালো লাগছে। বললেন সাবরিনা হাসান। তিনি পরিবার নিয়ে খুলনা থেকে আটঘর কুড়িয়ানায় বেড়াতে এসেছেন। সিলেট থেকে আসা পর্যটক সাকিব রহমান। তার ভাষায় এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য আসলে সরাসরি না দেখলে কেউ বুঝবে না। খালগুলো সুন্দরবনের মধ্যের খালের চেয়েও সুন্দর।
বাংলার আপেল
আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারাকে বলা হয় বাংলার আপেল। খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিগুণে অনন্য। আমলকী বাদে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি আছে পেয়ারায়। ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ১৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে। আরও আছে ভিটামিন বি১, বি২, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, আয়রন, ফসফরাস। জানা যায়, দেশি পেয়ারার প্রায় ষাট ভাগ এখানে উৎপাদন হয়। কোনো রাসয়নিক সার বা কীটনাশক দেওয়া হয় না। চাষিরা জানালেন, এখানে হেক্টরপ্রতি ১৫-১৬ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়। কিছু পেয়ারা বিদেশেও যাচ্ছে।
পেয়ারা ছাড়াও
জুন থেকে আগস্ট এ তিন মাস পেয়ারার মৌসুম। যখন পেয়ারা থাকে না তখনো এখানকার কৃষকরা অন্য ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হয়। কাগজি লেবু, আখ, শসা, সুপারি, আমড়া, কলাগাছের চারা ইত্যাদি উৎপাদনে তারা ভালো করছেন বলে জানা যায়। বরিশালের আমড়া, মিষ্টি আখের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কেবল পেয়ারা নয়। ভাসমান হাটে এসবও বিক্রি হয়। পেয়ারার মৌসুম ছাড়াও এ হাট বসে। পেয়ারার পাশাপশি এখানকার কৃষকরা বোম্বাই মরিচ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। জানা যায়, ২৮টি গ্রামের শত শত মানুষ বোম্বাই মরিচ চাষ করছে। মৌসুমে প্রতিদিন এ মরিচ ৯-১০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। স্থানীয় চাষি রিপন জানালেন, পেয়ারার পাশাপাশি বোম্বাই মরিচ চাষ করে তাদের ভালোই আয় হচ্ছে।
ভাসমান নৌকা ও গাছের চারার হাট
নদ-নদী, খাল-বিলবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চল। মানুষের জীবন-জীবিকায়, খাল-বিল জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। স্বরূপকাঠি থানার আদমকাঠিতে খালের মধ্যে বসে গাছের চারার হাট। ফলজ, বনজ, ফুলগাছের চারা বিক্রি হয়। পাইকাররা চারা কিনে ফরিদপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত আটঘর কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাটে ছোট নৌকার হাট বসে। কৃষি পণ্য তোলা, বিক্রিতে এ নৌকা ব্যবহার বেশি হয় বলে জানা যায়। দৃষ্টিনন্দন এসব নৌকা বিক্রি করে ইলুহার, গাগর, আতাকোঠালি, বৈঠাকাটা গ্রামের অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। স্বরূপকাঠির ১০ ইউনিয়নের প্রায় ১৩টি গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় নৌকা তৈরি করেন। সাতশ থেকে পাঁচ হাজার টাকায় একটি ছোট নৌকা কিনতে পাওয়া যায় বলে জানা যায়।
হিমাগার আজও হয়নি
পেয়ারা পচনশীল দ্র্রব্য। পেকে গেলে সংরক্ষণ করতে হয়। নতুবা নষ্ট হয়ে যায়। পেয়ারা চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবি একটি হিমাগার স্থাপন করার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু হিমাগার আজও হয়নি। পেয়ারার জেলি, দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়। তাই আটঘর, কুড়িয়ানা কিংবা ভিমরুলিতে জেলি কারখানা স্থাপন করা হলেও চাষিরা উপকৃত হতেন। তবে পাঁচ যুবক দুই একর জায়গার ওপর ন্যচারাল ট্যুরিস্ট আ্যন্ড পিকনিক স্পট গড়ে তুলেছেন। সেখানে পর্যটকরা বিশ্রাম নিতে পারেন।
