Logo
Logo
×

ফিচার

ভ্রমণ

ভালো থেকো জল-পাথারের পানকৌড়ি

Icon

হাসনাত মোবারক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শান্ত শরতের সকাল। দিগন্ত তখনো কুয়াশায় মোড়ানো। সামনের গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে না। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার একেকটি স্তর খুলে দৃশ্যমান হচ্ছে বিলপারের গ্রামগুলো। মুহূর্তে রূপ বদল হচ্ছে। সেদিন প্রকৃতির এ খেলা দেখছিলাম, চিনাধুকুড়িয়া গ্রামের এক ঘাটে বসে। এ গ্রামটির অবস্থান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার পশ্চিম সীমান্তে। চলনবিলের এ গ্রাম থেকে দক্ষিণে তাকালে থইথই জলরাশি। দেখে মনে হয় এসে পড়েছি বুঝি জলের সমুদ্রে। ইতোমধ্যে যাত্রী পারাপারের মাঝি হিরণ মিয়া তার নৌকা ঘাটে ভেড়ালেন। জানতে চাইলেন, আমি কোথাও যাব নাকি। তার কথার জবাব না দিয়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। উঠে তার কল তোলা নৌকাটিকে দক্ষিণের দিকে নিতে বললাম।

বিস্তৃত জলাভূমির মধ্য দিয়ে নৌকা এগিয়ে চলছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলে উঠছে ছোট ছোট জলজ লতাপাতা। ছড়ানো রয়েছে পানপাতার মতো হালকা হলুদ চাঁদমালার। এ ফুলগুলো চলনের স্বচ্ছ জলের ওপর যেন হেসে উঠছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ফাঁস জাল দিয়ে মাছ ধরা নৌকার দেখা পেলাম। প্রায় মাইলখানেক জলপথ পেরোনোর পর একটা ঘের জালের (স্থানীয়রা বাদাই জাল বলে) নৌকা দেখলাম। নৌকাটিতে সাতজন জেলে পানি থেকে জাল টেনে তুলছেন। কথা হয় ওই নৌকার বয়স্ক জেলে লিটনের সঙ্গে। জানান, পাশের চকহরিপুর গ্রামের মানুষ তারা। এ গ্রামের প্রায় সবাই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এ মৌসুমে। আগের চেয়ে এখন পানিতে মাছ কম। তবে দাম ভালো। উঁকি দিয়ে পাতিলে রাখা মাছ এক ঝলক দেখে নিলাম। হরেক রকমের মাছ খলবল করছে। জেলে লিটন বলেন, বাপু, আগে এক টানে দুই পাল্লা (পাতিল) মাছ পাছি (উঠত)। হে সম (তখন) বেচার জায়গা আছিল (ছিল) না। এহন তো মাছ মারার (ধরার) পর পরই নিকারিরা লিয়া (নিয়ে) যায়। ট্যাহা পাই ভালো।

কথা শেষ করে আমাদের নৌকা রওয়ানা দিল দক্ষিণ দিকে। চোখে পড়ল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সারি সারি গাছ পানিতে ভাসছে। কাছে গিয়ে দেখি বরুণ, হিজল পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঢোলকমলীসহ আরও কিছু জলজ উদ্ভিদ পানিতে ডুবসাঁতার খেলছে। মাছ শিকারি পাখিরা বড় গাছগুলোর ডালে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। বিলের অন্য জায়গার তুলনায় এখানে পানি কম। মাঝি জানালেন, এ জায়গার নাম বনপাড়ার গাঙ। সবাই ছোট গাঙ বলে। মাইলখানেক দক্ষিণে গেলে বড় গাঙ। সে গাঙের নাম জানতে চাইলে মাঝি একগাল হেসে বলেন, হে তো জানি না। হবাই (সবাই) বড় গাঙ কয়। ওইটা অবশ্য পাবনায় পড়ছে। মাঝিকে বলি ওই নদীর নাম গুমানী। চলনবিলের এ অংশে ছোট-বড় অনেক খাল, নদী বয়ে গেছে। মিশেছে বড়াল নদীতে। কিন্তু বর্ষায় সব একাকার হয়ে গেছে।

আষাঢ়-শ্রাবণে বিলের উথালপাথাল ঢেউয়ে জলরাশি উন্মাতাল রূপ নেয়। সে তুলনায় শরতে এ বিল অনেকটা ধীর স্বভাবের। এখন বিলের মধ্যে পানি কম। তাই জলাভূমি সেজেছে ছোপ ছোপ সবুজ রঙে। মাছ শিকারি পাখি দেখার এখনই মোক্ষম সময়। বনপাড়ার গাঙ থেকে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলছে পূর্বদিকে। একটু দূর এগিয়ে দেখি অনেকখানি জায়গাজুড়ে কালো রঙে ছেয়ে আছে। আর একটু পর যেতেই বুঝলাম, পানকৌড়ির ঝাঁক। সেখানে ঠিক কত পাখি আছে তা গণনার উপায় নেই। আমাদের শ্যালো মেশিনের ভুট ভুট শব্দে ওরা ওড়াউড়ি করতে লাগল। ঝাঁকবেঁধে দিল উড়াল। যে পানকৌড়িগুলো পানির তলদেশে ডুব মেরে ছিল তাদের উঠতে একটু সময় লাগল। তখনই সেগুলোর ছবি তুললাম। ছট ছট শব্দে পাখিগুলো উড়ে আরেকটু দূরে গিয়ে পানিতে নামল। কী মুগ্ধকর দৃশ্য। দিগন্ত যেন কালো ডানায় উড়াল দিচ্ছে।

বিলপারের গ্রাম থেকে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। আমাদের নৌকা গিয়ে থামল বিলের মধ্যে বয়ে যাওয়া আরেকটি নদীর পাড়ে। ওই নদীর পাড় জেগে উঠেছে। গাঙশালিক ডাহুক, ফিঙে দোয়েলসহ বেশ কিছু পাখির বিচরণ চোখে পড়ল এখানে। এর মধ্যে একজোড়া ঘোড়া দেখে অবাক হলাম। এই ধু-ধু পাথার। দ্বীপের মধ্যে এ ঘোড়া দুটির ছবিও তুলে নিয়ে ফিরে এলাম।

কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের তালগাছি, শাহজাদপুর, বাঘাবাড়ি অথবা পাবনার ফরিদপুর নেমে ভ্যানচালকদের বলতে হবে পাথারে যাব। তাহলে তারা পৌঁছে দেবেন নৌকা ঘাটে। অসংখ্য ঘাট রয়েছে বিলপারের গ্রামগুলোতে। বাস অথবা ট্রেনযোগেও যাওয়া যায়। ডে ট্রিপে ঘুরে দেখা যায়। চলনবিলের এ অংশটি ঘুরে দেখার পর রবীন্দ্র কাচারিবাড়িসহ রাউতারা জমিদার বাড়ি এবং বাঘাবাড়ি মিল্কভিটাসহ ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ মিলবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম