Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৩৬ বছরে ৩ কিমি. কাছে এসেছে সমুদ্র

সাগরের পেটে লোকালয় হুমকির মুখে কুয়াকাটা

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাগরের পেটে লোকালয় হুমকির মুখে কুয়াকাটা

প্রতিবছর একটু একটু করে লোকালয়ে ঢুকছে সমুদ্র। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম প্রান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা। জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্ব প্রান্তেও জনপদের দিকে এগোচ্ছে সাগর। গত ৩৬ বছরে এভাবে সাগরের পেটে গেছে পর্যটনকেন্দ্রের বহু স্থাপনা। যার আয়তন কম করে হলেও ৩ বর্গকিলোমিটার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিধ্বংসী হচ্ছে ভাঙনের এই ভয়াবহতা। এ বছরও উত্তাল ঢেউয়ের ঝাপটায় বিলীন হয়েছে সৈকত ঘেঁষে থাকা ১ হাজার ৩শ মিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। দোকান, স্থাপনাসহ আরও অনেক কিছু গিলে খেয়েছে সাগর। দুই যুগের বেশি সময় ধরে ভাঙনের এই তাণ্ডব চললেও তা ঠেকাতে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। বরঞ্চ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে নেওয়া সৈকত রক্ষা প্রকল্প পরপর ৩ বার ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সৈকত রক্ষায় সম্প্রতি সর্বশেষ আরও একটি প্রকল্প জমা হয়েছে ঢাকায়। তবে এই প্রকল্পের ভাগ্য নিয়েও সন্দিহান কুয়াকাটার মানুষ।

৩৬ বছর ধরে লোকালয়ের দিকে এগোচ্ছে সমুদ্র : ‘কুয়াকাটায় এখন যেখানে সমুদ্র, সেটি ছিল দক্ষিণে আরও ২ থেকে ৩ কিলোমিটার সামনে। বেড়িবাঁধ থেকে হেঁটে সৈকতে পৌঁছতে লাগত প্রায় ৪০ মিনিট। সেই ৩ কিলোমিটার এগিয়ে সাগর চলে এসেছে বেড়িবাঁধের কাছে। জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে থাকা মূল বাঁধ ভেঙেছে বহু আগেই। নতুন করে গড়া বাঁধও হুমকির মুখে। সেখান থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে পশ্চিমে আরও অন্তত ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত একই অবস্থা। পরিস্থিতি এমন যে বাঁধ টেকানোই মুশকিল। মাত্র ৩৫-৩৬ বছরে বিশাল এলাকা বিলীন হয়েছে সমুদ্রে। এলজিইডির বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট কাম রেস্ট হাউজ, বিশাল আয়তনের দৃষ্টিনন্দন নারিকেল বাগান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজসহ শত শত স্থাপনা। এ বছর বর্ষায় গেছে মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এভাবে চলতে থাকলে তো কুয়াকাটাই থাকবে না।’ হতাশার সুরে বলছিলেন কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য, আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ মো. ফারুক। ছোট বেলা থেকেই যিনি দেখছেন সাগরের ভাঙন। একা ফারুক নন, সমুদ্রের উন্মত্ততায় বিলীন হতে থাকা স্থাপনাগুলো এখন ভয় জাগাচ্ছে সবার মনে। বিশেষ করে দুশ্চিন্তায় পর্যটন বাণিজ্যে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীরা। কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম খান বলেন, এখানে কিন্তু সাগর ভাঙে না, ঢেউ এসে ধুয়ে নেয় তীর। এভাবে ধুয়ে ধুয়ে ঢোকে জনপদে। ১৫-২০ বছর আগে যখন ব্যবসা শুরু করি সমুদ্র তখন ছিল অনেকটা দূরে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তা এখন ঘরের দরজায়। সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে নতুন বেড়িবাঁধ-রিং বাঁধ করেও সামাল দেওয়া যায়নি কিছুই। আগে জোয়ারের সময় হেঁটে বেড়ানো যেত ১২ কিলোমিটার সৈকতে। এখন ভাটিতেও অনেক জায়গা থাকে পানির নিচে।

আরেক পর্যটন ব্যবসায়ী জাকির হোসেন আজাদ বলেন, বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কে ছিল ৬টি ফেরি। সেসব জায়গায় ব্রিজ হয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানী থেকে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাচ্ছে কুয়াকাটায়। ফলে আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। দিন দিন যেখানে সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে কুয়াকাটা, সেখানে আমরা শঙ্কিত সৈকতের অস্তিত্ব নিয়ে। যে আগ্রাসীভাবে এগোচ্ছে সাগর তাতে সবই এখন বিলীনের পথে।

তিনবার ফেরত সৈকত রক্ষা প্রকল্প : একই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কুয়াকাটা রক্ষায় ২০১৮ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব পাঠায় কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ওই প্রকল্পে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণসহ সাগর ভাঙন ঠেকাতে নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলেন তারা। অনুমোদনের বদলে ত্রুটির কথা উল্লেখ করে তা ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। ২০২১ সালের অক্টোবরে ২য় দফায় ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে আরেকটি প্রস্তাব পাঠানো হয় কমিশনে। এবারও সংশোধন-সংযোজনের কথা বলে তা ফেরত পাঠানো হয় কমিশন থেকে। এরপর ২০২২ সালে ১ হাজার ২১১ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ৩য় আরেকটি প্রকল্প কমিশনে জমা দেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে ভাঙন প্রতিরোধ ছাড়াও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ, বনায়ন, লাইফ গার্ড স্টেশন, পাবলিক টয়লেট ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেন তারা। এবারও কম গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে প্রকল্পটি ফেরত দেয় কমিশন।

কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন, চতুর্থবারের মতো আরও একটি প্রকল্প জমা দিয়েছি আমরা। ২০২৪ সালের মে মাসে জমা দেওয়া ওই প্রকল্পে ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার সৈকত রক্ষায় ৬৮টি গ্রোইন বাঁধ করার কথা বলা হয়েছে। শোর লাইন বা সৈকত প্রতিরক্ষা নামে ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫৯ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের শর্তানুসারে এবার আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) থেকে সম্ভাব্যতা যাচাই ও সুপারিশ নিয়ে প্রকল্পটি দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সংশোধনী চাওয়া হলে সে অনুযায়ী সংশোধিত প্রকল্প দাখিল হয় চলতি বছরের মার্চে। এটি পাশ হলে আশা করি ভাঙন ঠেকিয়ে সৈকত রক্ষা করা যাবে।

বারবার প্রকল্প ফেরতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন : চতুর্থবারের মতো জমা হওয়া এই প্রকল্পটিও আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান কুয়াকাটার মানুষ। ৩৬-৩৭ বছর ধরে সমুদ্র তীর ভাঙলেও তা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশও হয়েছে সেখানে। সর্বশেষ তাণ্ডবে মেরিন ড্রাইভসহ বেশ কিছু স্থাপনা বিলীন হওয়ার পর ২৬ জুলাই সাগর পাড়ে হয় ওই বিক্ষোভ। এতে অংশ নেন কুয়াকাটার হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কায়সার পর্যন্ত ছুটে যান কুয়াকাটায়। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, বহু বছর ধরে জনপদের দিকে এগোচ্ছে সাগর। সাগরের এই ধুয়ে নেওয়া ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলাসহ কিছু কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বালির বাঁধ দিয়ে তো আর সাগরের ঢেউ ঠেকানো যায় না। এই যখন পরিস্থিতি তাহলে কেন সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তারা কি চান না যে টিকে থাকুক কুয়াকাটা। হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, সরকারের এমন কোনো মন্ত্রণালয়-দপ্তর নেই যেখানে আবেদন করিনি। ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন এখানে। পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ হতে শুরু করল তখনই কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। মাঝে এত দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও কেন একই ভয়ে থাকতে হচ্ছে আমাদের? সরকারের কাছে প্রশ্ন, বিশ্বখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাকে রক্ষা করা কি তাদের দায়িত্ব নয়?

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম