Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ফুটওভারব্রিজ-‘প্রদীপের ওপরেও অন্ধকার’

চলন্ত সিঁড়ি চলে না ব্রিজ যেন বস্তি

সরেজমিন অনুসন্ধান

তোহুর আহমদ

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চলন্ত সিঁড়ি চলে না ব্রিজ যেন বস্তি

২২ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টা। ফার্মগেট ফুটওভারব্রিজ। চলন্ত সিঁড়ি অচল। কিন্তু সিঁড়ির মুখে পা ছড়িয়ে গভীর ঘুমে ছিন্নমূল দুই কিশোর। ব্রিজের উপরিভাগে পাটাতনের অংশটাও খালি নেই। সেখানে যেন হকারদের রাজত্ব। দুই পাশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসিয়ে চলছে হকারদের হাঁকডাক। ফলে পথচারীরা রাস্তা পারাপারের জন্য চলন্ত সিঁড়ির বিপরীতে থাকা হাঁটা সিঁড়ি দিয়েই ওঠানামা করছেন। এতে করে চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহার করে শিশুসহ বয়োবৃদ্ধদের সহজ পারাপার এখন কঠিন যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে এমন চিত্র শুধু ফার্মগেটে নয়, রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটওভারব্রিজেরই এমন জীর্ণদশা। বিশেষ করে চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আধুনিক নাগরিক সেবার যেটুকু সুনাম কুড়িয়েছিল তা এখন দুর্নামের সাইনবোর্ডে রূপ নিয়েছে। যদিও এ দুর্নাম ঘোচানো নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সম্প্রতি সপ্তাহব্যাপী যুগান্তরের সরেজমিন অনুসন্ধানে ফুটওভারব্রিজ ও চলন্ত সিঁড়ির এমন সাতকাহন বেরিয়ে আসে।

ফার্মগেট : প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ব্রিজটি উদ্বোধন করা হয় ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। কিন্তু মাত্র দুবছরের মাথায় এটি চলে গেছে ছিন্নমূল, হকার ও মাদকাসক্তদের দখলে। ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে প্রতিবেদক ফুটওভারব্রিজটি ব্যবহারের জন্য সেখানে উপস্থিত হন। এরপর যা দেখা গেল, তা ছিল বিস্ময়কর। ব্রিজের ভেতরটা যেন মিনি হাটবাজার। হরেকরকম পণ্যের পসরা। জুতা, সেন্ডেল, বেল্ট, মানিব্যাগ, চিরুনি, ঘড়ি ও মোবাইল ফোনের সরঞ্জাম।

ব্রিজের মাঝ বরাবর মেয়েদের পোশাকের পসরা বসিয়েছেন স্থানীয় হকার মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে বেচাকেনা বেশ ভালো। দৈনিক গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। চাঁদা দিতে হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি মুচকি হেসে উত্তর দেন ‘বলা নিষেধ। তাহলে এখানে বসতে পারব না।’

অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এভাবে ব্রিজের ওপর হকারদের দোকান বসতে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কতিপয় পাতিনেতা ছাড়াও সিটি করপোরেশনের অসাধু লোকজনও জড়িত। এছাড়া এসব ফুটওভারব্রিজ ঘিরে স্থানীয় মাস্তান ও হকারদের শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

বিমানবন্দর : রাজধানীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ব্রিজগুলোর আরেকটি হচ্ছে বিমানবন্দরসংলগ্ন ফুটওভারব্রিজ। এটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পথচারী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন। কিন্তু বর্তমানে এর অবস্থা করুণ বললেও কম বলা হবে।

এখানেও যথারীতি উভয় পাশের চলন্ত সিঁড়ি অকেজো। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ময়লা আবর্জনার নিচে চাপা পড়েছে ধাপগুলো। এমনকি কাচের রেলিংও ভেঙে পড়ছে। কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ ফুটওভারব্রিজ হওয়ায় মানুষকে বাধ্য হয়ে নানা দুর্ভোগ সহ্য করে এটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

মঙ্গলবার রাত ৮টায় ব্রিজের ওপর উঠে রীতিমতো ভূতুড়ে অবস্থা দেখা যায়। লাইট খুলে নেওয়ায় অন্ধকারময় ভূতুড়ে পরিবেশ। ব্রিজের ওপর পুরোনো স্টিলের ছাউনি জং ধরে ফুটো হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানিতে সয়লাব পাটাতন। কাদায় পিচ্ছিল পথ। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই পথচারীদের যাতায়াত। কোনোমতে কাদা এড়িয়ে পা টিপে পারাপার হচ্ছেন অনেকে। বিমানযাত্রীদের কেউ কেউ ওপর-নিচে ওঠানামা করছেন ট্রলি এবং ব্যাগ মাথায় করে।

এ সময় অনেককে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে শোনা যায়। সৌদিফেরত একজনকে বলতে শোনা যায়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের জন্য কত টাকা আমরা পাঠাই। অথচ দেশে ফিরে এসব কী দেখছি! সরকার বিমানবন্দরের ফুটওভারব্রিজটিও ঠিক করতে পারল না।

বনানী: মহাখালী হয়ে বিমানবন্দর যাওয়ার পথে রাস্তা দিয়ে এপার-ওপার হওয়া নিষিদ্ধ। পথচারীদের একমাত্র ভরসা এখানকার দুটি ফুটওভারব্রিজ। কিন্তু বিধি বাম। বনানী ব্রিজটি এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, দুপাশে সংযোজিত চলন্ত সিঁড়ি বহুদিন ধরেই নষ্ট। জংধরা কাঠামো। ধাপগুলো কয়েক জায়াগায় দেবেও গেছে। খুলে নেওয়া হয়েছে যন্ত্রাংশ। বেরিয়ে পড়েছে লোহালক্কড়ের কাঠামো। এমনকি স্টিলের কয়েকটি ধাপও নেই। কে বা কারা খুলে নিয়ে গেছে। মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে লাফিয়ে।

রমনা: রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটসংলগ্ন কংক্রিটের তৈরি ওভারব্রিজটি পুরোপুরি চলে গেছে ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষদের দখলে। এখানেও মানববর্জ্যরে দুর্গন্ধ। মনে হবে উন্মুক্ত পাবলিক টয়লেট। এ অবস্থায় নাক-মুখ চেপে ধরে পথচারীদের অনেকে বাধ্য হয়ে এটি ব্যবহার করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, ব্রিজের ওপর ছড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত ময়লা কাপড়, তৈজসপত্র এবং আখের ছোবড়া। দুপ্রান্তে ওঠার মুখে পলিথিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘর। একদিকের পথ আটকে আখের ছোবড়া পরিষ্কারের কাজ চলছে। অপরদিকে প্রকাশ্যে চলছে গাঁজা সেবনের আসর। রাজধানীর বুকে এ যেন ‘ফুটওভার বস্তি’। অথচ এই ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রতিদিন পতাকা উড়িয়ে ভিআইপিরা যাওয়া-আসা করেন। বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে বলতে হবে-এখানে প্রদীপের ওপরেও অন্ধকার।

মিরপুর ১০: এই ওভারব্রিজ নিয়ে স্থানীয়দের ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। তাই জুলাই আন্দোলনের সময় কেউ একজন ব্রিজে ওঠার মুখে লাল কালিতে লিখেছেন ‘দৃষ্টিনন্দন ফুটওভারব্রিজ চাই।’ কিন্তু অভ্যুত্থানের এক বছর পরও এ লেখাটি সিটি করপোরেশনের জন্য বিদ্রূপ হয়ে জ্বলজ্বল করছে। অর্থাৎ এমন দাবিনামা দেখেও কর্তাব্যক্তিদের মন গলেনি। অগত্য বলছি-জীর্ণদশা মিরপুর ফুটওভারব্রিজের কথা। দেখার কেউ নেই। ফলে আরও বিবর্ণ ও জীর্ণ হয়ে যেন সবকিছু খসে খসে পড়ার উপক্রম।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে এই ওভারব্রিজে আগুন দেওয়া হয়। এতে ছাউনি পুড়ে স্টিলের কাঠামো বেরিয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কংক্রিটের কাঠামো। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুদিন এটি বন্ধ ছিল। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য। মেরামত না করেই ঝুঁকিপূর্ণ ফুটওভারব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়। অগত্যা ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন এটি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

আশার বাণী: রাজধানীর ফুটওভারব্রিজগুলো সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি ফুটওভারব্রিজে সংযোজিত চলন্ত সিঁড়ি মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া অল্প সময়ের মধ্যেই সবগুলো ব্রিজের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক আনসার প্রহরা বসবে। এছাড়া যেসব জায়গায় ব্রিজ দরকার সেখানেও নতুন ব্রিজ স্থাপন করা হবে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ফুটওভারব্রিজগুলোর হালনাগাদ অবস্থা জানতে প্রকৌশল শাখার মাধ্যমে জরিপ করা হয়েছে। যেগুলোর কাঠামো সংস্কার করা প্রয়োজন-পর্যায়ক্রমে সেগুলো সংস্কার করা হবে।

এছাড়া ওভারব্রিজে হকার উচ্ছেদে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক জায়গায় ফুটওভারব্রিজের পরিবেশ ভালো থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে। এক্ষেত্রে নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম