জুলাই অভ্যুত্থানের মামলায় ৫৩ সাক্ষী
প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার হাসিনার নির্দেশেই
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও ব্লক রেইডের সিদ্ধান্ত হয় রাজনৈতিকভাবে। লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশনা এসেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, ডিবির হারুন ছিলেন মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩৬ দিনে ১ হাজার ৪শর বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। প্রায় ২৫ হাজার মানুষ আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তাদের বেশির ভাগ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে হতাহত হন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে এসব গণহত্যা সংঘটিত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ৫৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য বা জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে আসে। আজ (রোববার) মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্য শুনানি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর পরের ধাপে যুক্তিতর্ক শুনানি এবং আর্গুমেন্ট শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষীরা তাদের জবানবন্দিতে বলেছেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সহযোগী অন্যরা আন্দোলন দমনে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দিয়ে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’র সহ (গ্যাং) ৫টি অভিযোগ সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্যে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আসামি রয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামাল পলাতক। সাবেক আইজিপি মামুন এই মামলায় অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়ে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন।
প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা মনে করছি, শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যে ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো প্রমাণে প্রসিকিউশন সচেষ্ট ছিলাম। আসামিরা অপরাধ সংঘটন করছেন। তাদের অপরাধ প্রমাণ করতে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ দরকার-তা উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা তাদের শাস্তি দাবি করছি। তিনি বলেন, ফরমাল চার্জে এসব গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে অপরাধের নিউক্লিয়াস, মাস্টারমাইন্ড বলা হয়েছে। তার নির্দেশেই এসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে।
এ মামলায় গত ৩ আগস্ট থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরা হলেন-খোকন চন্দ্র বর্মণ, আবদুল্লাহ আল ইমরান, পারভীন আক্তার, রিনা মুর্মু, একেএম মঈনুল হক, আবদুস সামাদ, মিজান মিয়া, নাঈম শিকদার, শাহীনা বেগম, মো. এনাব নাজেজ জাকি, রবিউল আউয়াল, জসিম উদ্দিন, ডা. মাহফুজুর রহমান, শাহনাজ পারভীন, ডা. হাসানুল বান্না, সোনিয়া জামাল, মো. গিয়াস উদ্দিন, ডা. রাজিবুল ইসলাম, শরীফুল ইসলাম, ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, জাকিয়া সুলতানা নীলা, মোহাম্মদ ইদ্রিস, আমেনা আক্তার, হোসনে আরা বেগম, ডা. মফিজুর রহমান, ডা. মনিরুল ইসলাম, ডা. মোস্তাক আহমেদ, নাসির উদ্দিন, মো. সাঈদুর রহমান, মো. মোহিদ হোসেন, হুমায়ুন কবির লিটন, ডা. হাসানাৎ আল মতিন, তারেক নাসরুল্লাহ, ডা. মো. রশিদুল আলম, ডা. রাহাদ বিন কাশেম, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোহাম্মদ হাসান, সোহেল মাহমুদ, এসআই মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. জাকির হোসাইন, মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন, ইফতেখার আলম, শেখ নজরুল ইসলাম, মো. রুকনুজ্জামান, মো. শাহেদ জোবায়ের লরেঞ্চ, মাহমুদুর রহমান, নাহিদ ইসলালম, আলী আহসান জুনায়েদ, সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী, কামরুল হাসান, মো. কামরুল হোসাইন, আনিসুর রহমান, তানভীর হাসান জোহা।
গত ২ সেপ্টেম্বর এ মামলায় রাজসাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তিনি জবানবন্দিতে জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার বাড়াবাড়ি, পুলিশকে ব্যবহার করে ছাত্র-জনতাকে হত্যাসহ গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে কী ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘র্যাব-১ এ টিআইএফ নামে গোপন বন্দিশালা ছিল। র্যাবের অন্যান্য ইউনিটেও ছিল এমন বন্দিশালা। রাজনৈতিক ভিন্নমত ও সরকারের জন্য হুমকি হয়-এমন মানুষদের ধরে আনা হতো এখানে।’ মামুন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এসব নির্দেশনা। কখনো নির্দেশ দিতেন তারেক সিদ্দিকী। আর আয়নাঘরে আটক ও ক্রসফায়ারে হত্যার মতো কাজগুলো করতেন র্যাবের এডিসি অপারেশন ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক।’ জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কিছু কিছু কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল।’
সাবেক আইজিপি বলেন, ‘এসব কর্মকর্তা প্রায় রাতেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করতেন। গোপন সেসব বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলত। বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা হলেন-সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, এসবির মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এএসপি কাফী, ওসি মাজহার, ফোরকান অপূর্বসহ আরও অনেকে। এর মধ্যে কারও কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। রাজসাক্ষী মামুন আরও বলেন, ‘সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় চেইন অব কমান্ড মানতেন না এসব কর্মকর্তা।’ তার দাবি, ‘আমি চাইতাম তারা (পুলিশ কর্মকর্তারা) পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। মূলত পুলিশ বাহিনীতে দুটি গ্রুপ এসব কর্মকাণ্ড চালাত। এছাড়া দুই গ্রুপের নেতৃত্বদানকারীরা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।’ সমন্বয়কদের আটক ও নির্যাতনের বিষয়ে মামুন বলেন, ‘সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সমন্বয়কদের আটক করে মানসিক নির্যাতন করা হয়। একই সঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহারের বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়।’
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
