Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

যুগান্তরকে মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী

সংবিধান সমুন্নত থাক, জুলাই সনদ মর্যাদা পাক

তোফায়েল গাজালি

তোফায়েল গাজালি

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংবিধান সমুন্নত থাক, জুলাই সনদ মর্যাদা পাক

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। ছবি: সংগৃহীত

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। দেশবরেণ্য আলেম ও রাজনীতিক। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রাচীন ইসলামি রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব তিনি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি, জুলাই সনদ, ইসলামি দলগুলোর জোটসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন দৈনিক যুগান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-তোফায়েল গাজালি

যুগান্তর : আপনি কি নির্বাচন করবেন? করলে কোন আসন থেকে করবেন এবং মাঠের পরিবেশ কেমন দেখছেন?

আফেন্দী : ইনশাআল্লাহ আমি নির্বাচন করব। আমার নির্বাচনি আসনের পরিবেশও অত্যন্ত ভালো। ২০০১ থেকে আমি নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় আছি। ২৫ বছর ধরে জনসেবামূলক কাজ করেছি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। এসব কারণে আমি মনে করি, বর্তমানে আমার অবস্থান অত্যন্ত সন্তোষজনক এবং আমি শতভাগ আশাবাদী যে, সফল হব ইনশাআল্লাহ।

যুগান্তর : আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব। আপনার দলের নির্বাচনি প্রস্তুতি কেমন?

আফেন্দী : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি আমরা সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন করেছি। ইতোমধ্যেই প্রায় ১৫০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছি। প্রার্থীরা গণসংযোগ শুরু করেছেন, জনগণের সাড়া পাচ্ছেন। প্রার্থিতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা যোগ্যতা, সততা, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং নির্বাচনি সক্ষমতাসহ সব দিক বিবেচনা করেছি। ফলে আমাদের প্রস্তুতি সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে বলতে পারি।

যুগান্তর : এককভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে যাবেন?

আফেন্দী : আমরা দুধরনের সম্ভাবনাই খোলা রেখেছি। এককভাবেও লড়তে পারব, আবার জোটবদ্ধ হয়েও লড়তে পারি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আরও কিছু সময় নিতে হবে।

যুগান্তর : এককভাবে নির্বাচন করলে আপনার দল কতটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে করেন?

আফেন্দী : কিছু কিছু আসনে আমরা এককভাবেও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হব বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নীলফামারী, ফরিদপুর, নড়াইল ও গাজীপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় আমরা আশাবাদী। বাকি সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

যুগান্তর : আপনাকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে নিয়মিত দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো কি শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে বলে মনে করেন?

আফেন্দী : অধিকাংশ বিষয়েই ইতোমধ্যে দলগুলো একমত হয়েছে। যেখানে মতবিরোধ ছিল, সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে হলেও সমঝোতার চেষ্টা হয়েছে। আমি মনে করি কাক্সিক্ষত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতি যেন আমাদের ঐক্য দেখতে পায় আমরা সেভাবেই কাজ করছি।

যুগান্তর : পিআর ইস্যু ও জুলাই সনদ নিয়ে আপনার দলের অবস্থান কী?

আফেন্দী : শুরু থেকেই আমরা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। আমরা চাই প্রচলিত পদ্ধতিতেই ভোট হোক। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিষয়ে আমরা আপাতত একমত নই। আরও এক-দুই মেয়াদ পরে হতে পারে, আর পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আমরা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত মনে করি না। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, এমনকি ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এজন্য আমরা পিআরের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে আছি। আর জুলাই সনদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হলো, সনদের যেসব অংশ সংবিধানসংক্রান্ত, সেগুলো পরবর্তী সংসদের ওপর ন্যস্ত করা উচিত। আর যেগুলো সংবিধানসংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো নির্বাহী আদেশ কিংবা অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বশেষ আলোচনায় যেটি এসেছে, জাতীয় নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদের জন্য একটি আলাদা ব্যালট পেপার যুক্ত করা। আমরা সেই প্রস্তাব মেনে নিতে প্রস্তুত। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমরা চাই সংবিধান সমুন্নত থাক, জুলাই সনদও আইনি মর্যাদা পাক। আমরা মনে করি যেমন দুটি চোখই মানুষের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংবিধান ও জুলাই সনদ দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব নিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজন আছে বলে আমারা মনে করি না। রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমেই এগুলোর সমাধান করতে পারে ।

যুগান্তর : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বলছে, পিআর ছাড়া দেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, পিআর সংবিধানে নেই। বিএনপি আবার বিদ্যমান পদ্ধতির পক্ষে। এ অবস্থায় নির্বাচনের কী হবে বলে মনে করেন?

আফেন্দী : আমরা মনে করি নির্বাচন যথাসময়ে হবে ইনশাআল্লাহ। এ ব্যাপারে আমরা খুব দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। নির্বাচন কমিশন যে বক্তব্য দিয়েছে, সেটাই সঠিক, কারণ সংবিধানের ৬৫ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটেই সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হবেন। কাজেই পিআর পদ্ধতির দাবি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘পিআর ছাড়া ভোটে যাব না’ এমন অবস্থান সংবিধানবিরোধী এবং অযৌক্তিক।

যুগান্তর : অনেকে বলছে যারা পিআরের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তারা মূলত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই করছে। আপনি কীভাবে দেখেন?

আফেন্দী : রাজনীতিতে কারা স্বার্থপর আর কারা স্বার্থপর নয় তা ভেবে দেখবে জনগণ। তাদের দায়িত্ব হলো যুক্তি, বোধ ও বিবেক দিয়ে সবকিছু বিশ্লেষণ করা। মানুষের সচেতন হওয়া জরুরি। তারা যেন উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনে, ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়। এ দেশ কারও একার নয়, আমাদের সবার। তাই আবেগপ্রবণ না হয়ে যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্তই হবে সর্বোত্তম পথ। রাজনীতিকদের দায়িত্ব হলো মানুষকে সঠিকভাবে বোঝানো, বিভ্রান্ত করা নয়।

যুগান্তর : অনেকের মতে, আপনাদের অবস্থান ক্রমেই জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার দিকে যাচ্ছে। এটা কি খুব প্রয়োজন ছিল?

আফেন্দী : আমরা জামায়াতবিরোধী হয়ে যাইনি। আমরা আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতের স্বচ্ছ আকিদা ও বিশ্বাসের হেফাজতের প্রশ্নে আপসহীন। ইলমে ওহির সুরক্ষা, মসজিদ-মাদ্রাসা, খানকাহ, দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ যেন সুরক্ষিত থাকে, সেটিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এটিকে যদি কেউ জামায়াতবিরোধিতা মনে করে, তা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা শুধু আমাদের আকিদা ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব পালন করছি।

যুগান্তর : কিন্তু অতীতে তো আপনারা জামায়াতের সঙ্গে চারদলীয় জোটে ছিলেন। তখন আপনারা এ মতপার্থক্যগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা করেননি কেন?

আফেন্দী : প্রথম কথা হলো, আমরা জামাতের নেতৃত্বাধীন কোনো জোটে কখনোই ছিলাম না। আমরা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলাম, সেখানে জামায়াতও শরিক দল হিসাবে ছিল। দ্বিতীয়ত জামায়াতে ইসলামীর ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস নিয়ে আমরা কথা বলিনি এটা ভুল ধারণা। আমরা এ বিষয়ে সবসময়ই সোচ্চার ছিলাম। আমাদের পূর্বসূরিরা তো জামায়াতের মতাদর্শ নিয়ে একাধিক গ্রন্থ লিখে জাতিকে সতর্ক করেছেন।

যুগান্তর : তাহলে এ মতপার্থক্যগুলো সমাধানের কোনো পথ নেই?

আফেন্দী : আলোচনার টেবিলে বসে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে হবে। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা ছিল হানাদার বাহিনীর পক্ষে, আর আমরা ছিলাম মুক্তিকামী জনগণের পাশে। তাদের প্রশ্নবিদ্ধ এ ভূমিকাকে ইতিবাচ চোখে দেখার সুযোগ নেই। কাজেই জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যকার মতাদর্শগত যে দ্বন্দ্ব তার সমাধান অনেক কঠিন।

যুগান্তর : গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মুখে মুখে একটি কথা ‘ইসলামি দলগুলোর জোট।’ যদিও আলোচিত জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ উঠেছে, আপনারা বিনা নোটিশে লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। আসল ঘটনা কী?

আফেন্দী : এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। জমিয়ত ঐতিহাসিকভাবে ঐক্যের প্রশ্নে সর্বদা আন্তরিক। হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সময় থেকে শুরু করে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আন্দোলন, হেফাজতের শাপলা চত্বর আন্দোলন এবং মোদিবিরোধী আন্দোলন সব জায়গায়ই আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি।

ইসলামি দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আমরা বলেছিলাম, প্রথমে আমাদের সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সুসংহত করতে হবে, তারপর বড় দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোটের প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু যখন দেখলাম পিআরের মতো বিতর্কিত ইস্যু সমন্বয়হীনভাবে মাঠে চলে আসছে, তখন আর লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমরা উচিত মনে করিনি। আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট, একদিকে এক বাক্সকেন্দ্রিক ঐক্য অন্যদিকে পিআর পদ্ধতির জন্য আন্দোলন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি বিষয় একসঙ্গে চলতে পারে না।

আমরা চাই ঐক্য যেন টেকসই হয়, স্বচ্ছ হয়, আদর্শভিত্তিক হয়। মুখে একবাক্স বলবেন আর পেছনে পিআরের মতো অসাংবিধানিক দাবি চাপিয়ে দিতে চাইবেন, সেটি আমরা মেনে নিতে পারি না।

যুগান্তর : জামায়াতের সঙ্গে জোটের আলোচনা এলেই সবসময় আপনারা বিশ্বাস ও আদর্শকে সামনে নিয়ে আসেন। বলা হয়, এই একটি কারণেই অতীতের সম্ভাবনাময় বহু জোট অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু আপনারা বিএনপির সঙ্গে জোট করেন, আন্দোলনও করেন। বিএনপির সঙ্গে কি আপনাদের আদর্শের মিল আছে?

আফেন্দী : জোটের ক্ষেত্রে আমাদের মূলনীতি স্পষ্ট, আমরা এমন কারও সঙ্গে জোট করতে চাই না, যার ফলে হাজার বছরের ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা ও দর্শন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিএনপির সঙ্গে জোট হলে অন্তত সরাসরি ইসলামের ক্ষতি আমরা দেখি না। কারণ বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল, তারা নিজেকে ইসলামি দল বলে দাবি করে না। তারা ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী এটা বলে। তাদের থেকে ইসলামবিরোধী আপত্তিকর বক্তব্য আসলে আমরা সেটারও প্রতিবাদ করি। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দ্বীনের মৌলিক অনেক বিষয়ে আলেমদের দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তারা সুসংহত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। দ্বীন, ইমান ও শরিয়তের বহু বিষয়ে আলেমদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বাইরে তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে। তাই তাদের সঙ্গে জোটগত আন্দোলনে গেলে আমাদের জনশক্তি বিভ্রান্ত হওয়ার প্রবল শঙ্কা থাকে। তাই আমরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে যেতে চাই না।

যুগান্তর : আগামী নির্বাচনে বিএনপি নিশ্চয়ই আপনাদের পাশে চাইবে। আপনারা থাকবেন কি?

আফেন্দী : বিএনপি চাইলে হবে না, আমাদেরও চাইতে হবে। দুই চাওয়া মিলে গেলে এবং ক্ষতির ঝুঁকি কম থাকলে সময়ই বলে দেবে আমাদের অবস্থান কী হবে।

যুগান্তর : বাংলাদেশে আলেমদের নেতৃত্বে এখনো টেকসই জোট হয়নি। এটা কীভাবে সম্ভব বলে মনে করেন?

আফেন্দী : ইসলাম আমাকে নিরাশা শেখায় না। হক্কানী আলেমদের নেতৃত্বে কাক্সিক্ষত ঐক্য এখনো হয়নি, সত্যি। কিন্তু হবে না, এমনও নয়। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি সবাই আত্মত্যাগের মানসিকতা দেখান, অন্যকে সামনে এগিয়ে দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলেন, তাহলে ঐক্য সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হলো ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা নেওয়া, বিভাজন সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো নির্মূল করা।

যুগান্তর : গত এক বছরে আপনাকে বহুবার বলতে শুনেছি ‘আগে বিচার-সংস্কার, তারপর নির্বাচন’। নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ তো জানলাম। বিচার-সংস্কার হয়েছে কি?

আফেন্দী : আমি আসলে কখনো বলিনি আগে বিচার-সংস্কার, পরে নির্বাচন। বরং বলেছি, বিচার চাই, সংস্কার চাই, দ্রুত নির্বাচনও চাই। আমাদের দাবি আলাদা আলাদা। একটি দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরেকটি দাবিকে ছাড় দেওয়া আমাদের নীতি নয়। আমরা চাই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচার হোক, কিন্তু সেই অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত হোক, এটা চাই না। কিছু কিছু বিচার তো হয়েছে, কিন্তু আমরা সন্তুষ্ট নই। বিচার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করা জরুরি। তবে এ অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়। কারণ দীর্ঘমেয়াদি অনির্বাচিত সরকার দেশের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকির কারণ।

যুগান্তর : আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতিতে বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। এরকম অবস্থায় নির্বাচন বয়কটের খবরও শোনা যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ‘নির্বাচনের বিকল্প ভাবলে গভীর বিপদ।’ আপনি কী একমত?

আফেন্দী : আমি পুরোপুরি একমত। নির্বাচনটা দ্রুতই হওয়া উচিত। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবিও বটে।

যুগান্তর : অনেকে বলছেন, এখনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। আপনার কী মনে হয়?

আফেন্দী : আমি মনে করি, জাতি ইতোমধ্যেই নির্বাচনের ট্রেনে উঠে গেছে। নির্বাচনের টাইমলাইন ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সারা দেশে নির্বাচনি আমেজ বিরাজ করছে। যারা পিআর নিয়ে আন্দোলন করছে, তারাও মাঠে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় সময় পার করছে। মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে। এখন যদি বলা হয় পরিবেশ নেই, তাহলে প্রশ্ন ওঠে তারা কেন প্রচারণা চালাচ্ছে? তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা এ মুহূর্তে অপরিহার্য।

যুগান্তর : শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা বিদেশ থেকে নানা উসকানি দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য?

আফেন্দী : এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। একজন নেতা ভুল করতে পারেন, কিন্তু জনগণের কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করা উচিত। ক্ষমা চাইলে মানুষ হয়তো সহমর্মিতা দেখাত। কিন্তু উলটো উসকানির কারণে তাদের আরও কঠিন পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

যুগান্তর : ‘আওয়ামী লীগ আরও ভয়ংকররূপে ফিরে আসবে’ একটি ভাইরাল ডায়ালগ, আওয়ামী লীগ ফিরে আসার শঙ্কা করেন?

আফেন্দী : ভয়ংকরভাবে ফিরবে এ ডায়ালগই ফ্যাসিবাদী মানসিকতারই পরিচায়ক। যদি তারা বলত, ‘আওয়ামী লীগ সুন্দরভাবে ফিরবে’ তাহলে সেটা রাজনৈতিক বক্তব্য হতো। কিন্তু ভয়ংকরভাবে ফেরা মানেই তারা অতীতেও ফ্যাসিবাদী ছিল, এখনো আছে। ফ্যাসিবাদীদের আর কোনো সুযোগ বাংলাদেশের মানুষ দেবে না।

যুগান্তর : আপনি শতবর্ষী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলুন?

আফেন্দী : জমিয়তের জন্ম শুধু একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক সাহসী ঘোষণা। এটি এক অনন্য সোনালি ইতিহাস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত শাসনের বিরুদ্ধে উপমহাদেশকে মুক্ত করার দীপ্ত শপথ নিয়ে মাঠে এসেছিল জমিয়ত। ফলে অসংখ্য আলেমের লাশ ফাঁসির মঞ্চে ঝুলেছিল, রক্ত ঝরেছে পথে পথে। দিল্লির জামে মসজিদ চত্বর ফাঁসির মঞ্চে পরিণত হয়েছিল। একজন শহীদ হলে, তার জায়গায় অন্য একজন সাহসী আলেম এগিয়ে এসেছেন, এই ধারাবাহিক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জমিয়ত আমাদের কাছে এসেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পাঠ্যপুস্তক থেকে পরিকল্পিতভাবে এ ইতিহাস সরিয়ে ফেলা হয়েছে, আমরা তীব্রভাবে এর নিন্দা করি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকায় জমিয়তের সংগ্রামী ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যেন নতুন প্রজন্মও জানে এই সাহস ও ত্যাগের গল্প।

যুগান্তর : আপনাদের লক্ষ্য তো ইসলামমি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় গিয়েই কি তা সম্ভব?

আফেন্দী : আমরা জানি, একই দিনে সবকিছু হবে না। তবে বাংলাদেশে ইসলামকে উপেক্ষা করে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না, টিকতেও পারবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের সামনে ইসলামি শাসনব্যবস্থার সৌন্দর্য তুলে ধরা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। সময় লাগবে, কিন্তু আমরা চেষ্টা করব। সম্ভব না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই দায়িত্ব সম্পাদন করবে, ইনশাআল্লাহ।

যুগান্তর : ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিচার কাঠামো কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন? আধুনিক যুগের আইন, আদালত ও দণ্ডবিধি এসবের সঙ্গে কীভাবে সামঞ্জস্য করবেন?

আফেন্দী : ইসলামি শাসন মানুষের অধিকার খর্ব করার জন্য নয়, বরং সুরক্ষার জন্য। ইসলামে কোনো ত্রুটি নেই। যখন শরিয়াহভিত্তিক শাস্তি কার্যকর হবে, তখন মানুষ দেখবে সত্যিকারের নিরাপত্তা কাকে বলে। আমরা ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় একটি স্বতন্ত্র শরিয়াহ আদালত প্রতিষ্ঠা করতে। এটি নারীদের বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, ধর্ম অবমাননা ইত্যাদি বিষয়ে রায় দেবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে আমাদের এ প্রস্তাব কখনো আলোচ্যসূচিতে তোলা হয়নি। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

যুগান্তর : রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আপনার দলের অগ্রগতি কী?

আফেন্দী : আমরা নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি, শতভাগ পূরণ করতে না পারলেও আংশিকভাবে আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি। বর্তমানে আমাদের ২০১ সদস্যের কমিটিতে প্রায় ২০ জন নারী রয়েছেন। যদিও শর্ত অনুযায়ী সংখ্যা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল, তবুও আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছি।

যুগান্তর : দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা কি সম্ভব?

আফেন্দী : না, তা কখনো সম্ভব নয়। নারীরা মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী, প্রতিটি পরিচয়ে আমাদের কাছে সম্মানের আসনে। ইসলাম তাদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাই নারীদের অবহেলা করে কোনো রাষ্ট্র সফল হতে পারে না।

যুগান্তর : বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ভবিষ্যৎ আপনি কেমন দেখছেন?

আফেন্দী : আমরা আশাবাদী যে, ইসলামি রাজনীতি আরও সক্রিয় ও প্রভাবশালী চেহারায় আবির্ভূত হবে।

যুগান্তর : জুলাই বিপ্লবে দেশের আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিয়ে আপনি কী বলবেন? ৫ আগস্টপরবর্তী নতুন বাস্তবতায় তাদের কতটুকু মূল্যায়ন হয়েছে?

আফেন্দী : মূল্যায়নের ক্ষেত্রটি কিছুটা সংকুচিত। এটি দুঃখজনক। আমাদের অংশগ্রহণকে হাইড করা হয়েছে। আমরা এটাকে সংকীর্ণতা বলি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ফ্যাসিবাদী শাসকদের পতন নিশ্চিত করেছে, কিন্তু এটি একক কোনো দলের বা নেতার অর্জন নয়। দেশের সব স্তরের মানুষ, সব দল ও মতের, অংশগ্রহণ ছিল। যারা এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে, তারা মূলত সংকীর্ণ চেতনার রাজনীতি করতে চায়। আমাদের দলের কয়েকজন শহীদ হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছেন। কওমি ও ইসলামি অঙ্গনের শহীদ প্রায় ৯০-৯২ জন। সরকারি বা রাজনৈতিক স্তরে তাদের যথাযথ খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। তবে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দলীয়ভাবে যতটুকু সম্ভব করেছি।

যুগান্তর : মূল্যায়ন না পাওয়ার দায় কাদের?

আফেন্দী : কিছুটা তো অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। স্টেকহোল্ডার ও সম্মুখ যোদ্ধাদেরও কিছুটা দায় আছে। তবে আমরা মনে করি, আসল মূল্যায়ন আল্লাহর কাছে। আমরা সাধ্যানুসারে আহতদের যতটুকু সহায়তা করতে পারি, করেছি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কোনো চেষ্টা আমরা করি না।

যুগান্তর : জুলাই বিপ্লব তো প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল। আপনারা কীভাবে যুক্ত হলেন?

আফেন্দী : ২৪ শে কোটা আন্দোলন ছিল মূলত সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আমরা প্রথমে সংহতি প্রকাশ করেছি। জুলাইয়ের প্রথম ও শেষ দুই সপ্তাহে যখন আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হলো এবং তাদের প্রতি হেনস্তা বৃদ্ধি পেল, তখন সরাসরি দলীয়ভাবে আমরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

যুগান্তর : আলেম হিসাবে রাজনীতিতে আপনাদের কেমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়?

আফেন্দী : প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, অনেকের ধারণা আলেমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষ। এটি খণ্ডন করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ অনেকে মনে করেন, আলেমদের রাজনীতিতে থাকা উচিত নয়, তারা শুধু ধর্মীয় কাজ করবেন। এই কনসেপ্টকে ভেঙে রাজনীতিতে আলেমদের প্রয়োজনীয়তাকে আমাদের প্রমাণ করতে হয়।

যুগান্তর : জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এ সময় ইসলামপন্থিদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি কী?

আফেন্দী : প্রাপ্তি হলো মুক্ত পরিবেশে কর্মসূচি পরিচালনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারা। অপ্রাপ্তি হলো, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকায় অফিস খোলা, পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা এবং আমাদের অঙ্গনকে কম গুরুত্ব দেওয়া।

যুগান্তর : ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে জুলাই বিপ্লবপরবর্তী বিচার-সংস্কার ইত্যাদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। সরকার নিশ্চয়ই আপনাদেরকে তাদের এ মেসেজ জানিয়েছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনারা আশ্বস্ত হতে পারেননি। সেটি কেন?

আফেন্দী : জমিয়ত ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। আমরা মনে করি জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস আমাদের দেশে পশ্চিমা মডেলের নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কার্যক্রম চালাবে, যা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

যুগান্তর : সম্প্রতি আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল আফগানিস্তান সফর করে এলেন। সেখানে আপনার দলের নেতাও ছিলেন। এ সফরের উদ্দেশ্য কী ছিল?

আফেন্দী : এটা একান্ত তাদের ব্যক্তিগত সফর ছিল।

যুগান্তর : সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আপনার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?

আফেন্দী : যে যেখানে আছেন সেখানে সততার পথ আঁকড়ে ধরে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুখের দাবি যথেষ্ট নয়, কর্মেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নিজেকে বারবার পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং দায়িত্বের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে।

যুগান্তর : যুগান্তরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আফেন্দী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম