একান্ত সাক্ষাৎকারে মজিবুর রহমান মঞ্জু
রাজনৈতিক ঐক্যে প্রধান বাধা ইগো
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, রাজনৈতিক ঐক্যের প্রধান বাধা হলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজেদের ইগো। তিনি আরও বলেন, প্রায় দুই যুগ নানা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বন্ধন গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ঐক্যবদ্ধ ছিল। উভয় দলের নেতাকর্মীরা ছিলেন চরমভাবে নির্যাতিত।
কিন্তু পরিবেশ তাদের অনুকূলে আসার পর বছর না ঘুরতেই দলগুলোর মনোভাবে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন ধীরে ধীরে অহংকারী ও প্রতাপশালী চরিত্রে আবির্ভূত হতে চলেছেন। নানা স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া এবং সেটিকেই একমাত্র লক্ষ্য বানানোই বিভক্তি ও বিভাজনের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।
সম্প্রতি যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মজিবুর রহমান মঞ্জু এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ মামুনুর রশীদ।
যুগান্তর : গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তির মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ ও অনৈক্য দেখা দিচ্ছে। কেন এই অনৈক্য?
মজিবুর রহমান মঞ্জু : রাজনৈতিক ঐক্যের প্রধান বাধা হলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজেদের ইগো।
যুগান্তর : গণভোট এবং পিআর নিয়ে মতবিরোধ, এর পরিণতি কী হবে বলে মনে করেন।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : গণভোট ও পিআর নিয়ে মতভেদটা তেমন মৌলিক কিছু না; কিন্তু এটিকে গণমাধ্যমসহ অনেকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমি এটিকে স্রেফ দলের একটা বার্গেইনিং ইস্যু আকারে দেখি। সরকার একটি সুস্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে দিলে এই মতবিরোধের সমাধান হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
যুগান্তর : বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নানা ইস্যুতে অনড়, তাদের মধ্যে দূরত্ব দিনদিন বাড়ছে। এর ফলাফল কী হবে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : যৌক্তিক কারণে দূরত্ব বাড়লে সমস্যা নেই; কিন্তু স্বার্থগত কারণ, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে ক্যাচাল এবং দূরত্ব বাড়লে দলগুলোর প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হবে। এটির ফল খুবই খারাপ হবে। নতুন প্রজন্মের যারা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। মানুষ যে পরিবর্তিত বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেছিল, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অদূরভবিষ্যতে এ হতাশা ও ক্ষোভ গণবিপ্লবের জন্ম দিতে পারে।
যুগান্তর : এই অনৈক্যের সুযোগ কে বা কারা নেবে? কী মনে হয় আপনার।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : এই অনৈক্যের সুযোগ নেবে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগ এবং তাদের বেনিফিশিয়ারি গোষ্ঠী। সীমান্তের বাইরের শক্তিগুলোও এটিকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করতে চাইবে। তবে যখনই তারা অনৈক্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দৃশ্যমান কিছু করতে চাইবে, তখনই গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি আবার সংঘবদ্ধ হয়ে যাবে। এর কারণ হলো ফ্যাসিবাদী হত্যাযজ্ঞ এবং লুটপাটের স্মৃতি এখনো মানুষের হৃদয়ে দগদগে ঘা হয়ে আছে।
যুগান্তর : নির্বাচন কি ফেব্রুয়ারিতে হবে, নাকি না হওয়ার শঙ্কা আছে? কী মনে করেন।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। সবাই শুধু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের কথা বলে; কিন্তু কে ষড়যন্ত্র করছে তা স্পষ্ট করে বলে না। আমি তো মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ যে তিনটি দল, যাদের তিনি জাতিসংঘের অধিবেশনে দুপাশে বসিয়ে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রমাণ উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, তারা ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন সুন্দরভাবে হবে। কিন্তু তারা যদি মুখে এক আর অন্তরে ভিন্ন লালন করেন, তাহলে ষড়যন্ত্রও সফল হবে, আর নির্বাচন হলেও তা হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
যুগান্তর : প্রশাসন দলীয়করণের অভিযোগ করছে বিএনপি ও জামায়াত। এতে আগামী নির্বাচন কি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে হয়?
মজিবুর রহমান মঞ্জু : আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে উদ্বেগের কথা আমরা সব সময় বলে এসেছি। প্রশাসন ও পুলিশে বিএনপি এবং জামায়াতের প্রভাব খুবই স্পষ্ট। প্রশাসনের মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদের লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করেছেন, তারা এখন সবচেয়ে বেশি বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। দুপক্ষই এ নিয়ে একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে। উভয় দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেখানেই অভিযোগ এসেছে, সেখানে প্রশাসনকে দৃঢ় ও কার্যকর ভূমিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি না। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন এটা খুবই সংকট তৈরি করবে। জামায়াত ও বিএনপি উভয় পক্ষের বিরোধ সহিংসতায় রূপ নিলে প্রশাসন কার্যকর কিছু করতে পারবে বলে এখনো আস্থা পাচ্ছি না।
যুগান্তর : নির্বাচনে আপনার দল এককভাবে নাকি জোটগতভাবে অংশ নেবে? জোট করলে কাদের সঙ্গে করবেন।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : আমাদের দলটা একেবারেই নতুন। দলকে আমরা এখনো গুছিয়ে নিতে পারিনি। তা সত্ত্বেও আমরা এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ১৬ অক্টোবর প্রাথমিকভাবে মনোনীত ১০০ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করব। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও ঐক্যকে ধারণ করে, এমন দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করা যায় কি না, তা নিয়েও বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ করছি। চূড়ান্তভাবে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামেই হবে। জোট যদি করি, যাদের সঙ্গে নীতি-কর্মকৌশল বেশি মিলবে, তাদের সঙ্গেই জোট করব।
যুগান্তর : নির্বাচনে কত আসনে প্রার্থী দেবে এবি পার্টি।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : প্রথম পর্যায়ে আমরা ১০৯ জনকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দিচ্ছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে নভেম্বরে আরও ১০০ জনকে মনোনয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা তো আছে, যদি আমাদের দল এককভাবে নির্বাচন করে, তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে আমরা প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করব।
যুগান্তর : এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সেনা হেফাজতে আছেন। তাদের কারণে কি সেনাবাহিনী বিতর্কিত হবে না। কেউ কেউ কি সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। কী মনে হয়।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : যেসব সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের প্রতিটি অভিযোগেরই যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে শুনেছি। এতে প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন্ন হওয়ার সুযোগ তো আছেই। কারণ, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং অপেক্ষাকৃত দুর্নীতিমুক্ত ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত। অতীতে সেনাবাহিনীতে বহু বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছে, অনেকগুলো ছোট-বড় বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসাবে তারা বারবার শৃঙ্খলায় ফিরে এসেছে। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা আগেও ছিল, এখনো আছে। অতীতের তুলনায় এবারের বিষয় অত জটিল বা কঠিন নয়। এবারের পরিস্থিতিও তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং অত্যন্ত ভালোভাবে পারা উচিত বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : বিবিসিকে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন। এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : সাক্ষাৎকারটি চমৎকার ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করি। ওনাকে এজন্য ধন্যবাদসূচক মেসেজও পাঠিয়েছি, তিনি এর প্রতি-উত্তরে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তার কাছে নাগরিকদের অনেক কিছু জানার ছিল, এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যার একটা বড় অংশ কাভার হয়েছে। আশা করি, এ ধরনের সাক্ষাৎকার তিনি আরও দেবেন।
যুগান্তর : আরেকটি বিষয়-আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে বলে মনে করেন। মাঠপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলই আওয়ামী লীগের ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছে। কীভাবে দেখেন বিষয়টি।
মজিবুর রহমান মঞ্জু : আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বের ভুলের কারণে আদর্শিক দিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তার দলীয় কাঠামো অক্ষত আছে। দলের নেতৃত্ব যদি ভুল শুধরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চায়, তাহলে সেটা একটা বিবেচনার বিষয়। কিন্তু আমার মনে হয় না আওয়ামী লীগ ভুল শুধরে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে হাঁটবে। তারা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের পথে আছে এবং সে পথেই এগোচ্ছে। এতে তার দলীয় কাঠামো ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভক্ত হয়ে প্রভাবশালী দলগুলোয় ঢুকে পড়বে। দলগুলোও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ব্যবহার করবে এবং নানা সুযোগ-সুবিধা নেবে। নির্বাচনে যত সন্ত্রাস ও সহিংসতার ঘটনা ঘটবে, বেশির ভাগই হবে আওয়ামী লীগের লোকদের দলে ঢোকানাকে কেন্দ্র করে। মোদ্দা কথা, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ তাদের মাথায় ও হাতে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
মজিবুর রহমান মঞ্জু : আপনাকেও ধন্যবাদ।

