গুম খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন মামলা
১৫ সেনা কর্মকর্তা কারাগারে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: সাবেক-বর্তমান ১০ সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ আসামিকে হাজিরে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ * পরবর্তী শুনানি ৫ ও ২০ নভেম্বর * বিচার প্রক্রিয়াকে সুচারুভাবে পরিচালনায় সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে : চিফ প্রসিকিউটর * গণমাধ্যমকর্মীকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেওয়ায় এসবির কর্মকর্তাকে পুলিশ কর্মকর্তার হুমকি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিন মামলার আসামি ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের মধ্যে ১৪ জন কর্মরত আছেন। একজন আছেন অবসরকালীন ছুটিতে। এসব মামলায় পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক-বর্তমান ১০ সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ জন আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার আদালতে হাজির করা হলে কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আদালতের আদেশের পর তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডে সাব-জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে সকাল সোয়া ৭টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সবুজ রঙের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রিজন ভ্যানে অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে আনা হয়। তারা সবাই সাধারণ পোশাকে ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে থাকাবস্থায় তাদের বিষণ্ন দেখায়। দুটি গুমের মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ২০ নভেম্বর এবং জুলাই আন্দোলনের মামলায় ৫ নভেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে আনলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের পক্ষে আইনজীবীরা হাজির হয়ে ওকালতনামায় সইয়ের অনুমতি নিয়েছেন। তারা বলেছেন জামিনের আবেদন করতে চান। আদালত বলেছেন, এটার একটা প্রক্রিয়া আছে, প্রথমে ওকালতনামায় সই, তারপরে নিয়মিতভাবে আবেদন করবেন। আদালত বলেছেন, আবেদন থাকলে রেজিস্ট্রার অফিসে আইন অনুযায়ী দাখিল করবেন। আসামিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য (আইনজীবীরা) মৌখিকভাবে আবেদন করেছেন। সেটা মঞ্জুর করেছেন। কারাগারে পাঠানোর মানে হচ্ছে তারা কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কোথায় রাখবেন, সেই এখতিয়ার কারা কর্তৃপক্ষের বলে মন্তব্য করেন চিফ প্রসিকিউটর।
অন্যদিকে ১৫ সেনা কর্মকর্তা নির্দোষ বলে দাবি করে তাদের আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন বলেছেন, এ মামলার মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। সেনা সদরের আদেশে সংযুক্তকৃত ১৫ জন অফিসার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেছেন। ট্রাইব্যুনাল ১৫ জন অফিসারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে এই সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সেনানিবাসের সাব-জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনানিবাসের বাশার রোডসংলগ্ন ‘এমইএস বিল্ডিং নম্বর-৫৪’-কে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করে। মামলা তিনটির মধ্যে দুটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনার। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এসব মামলায় সাবেক-বর্তমান ২৫ সেনা কর্মকর্তাসহ আসামি ৩২ জন। তাদের বিরুদ্ধে ৮ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কর্মরত ১৪ জন এবং অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে থাকা ১ কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সেদিন সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হেফাজতে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বুধবার ভোর থেকে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সবাইকে বিশেষ চেকিং পার হয়ে ঢুকতে হয়েছে। সকাল সোয়া ৭টায় বাংলাদেশ জেল-প্রিজন ভ্যান লেখা সবুজ রঙের গাড়িতে এই ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আনা হয়। গাড়িটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল। সবুজ সেই বাসে লেখা ছিল, বাংলাদেশ জেল, প্রিজন ভ্যান। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে যান। এ সময় সেনা কর্মকর্তাদের সাধারণ পোশাকে দেখা যায়। কারও কারও মুখে ছিল মাস্ক। পরে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ফটক দিয়ে তাদের বের করে সাব-জেলে নেওয়া হয়।
সকাল ৮টার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে ১৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে প্রথমে ১০ জন, এরপর তিনজন এবং সবশেষে ২ জনকে এজলাসে তোলা হয়। এ সময় ডকে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের নাম জিজ্ঞাসা করে পরিচয় শনাক্ত করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান। শুরুতেই পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় ১৫ জন সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন আদালতে বলেন, এ মামলার মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। সেনা সদরের আদেশে সংযুক্তকৃত ১৫ জন অফিসার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা জামিন এবং অনলাইনে মামলার হাজিরার জন্য পৃথক আবেদন করেছেন। শুনানি নিয়ে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সাত দিনের মধ্যে পলাতক আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য দুটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে যাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আরও আছেন শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআই-এর সাবেক পাঁচজন মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক, ডিজিএফআই-এর সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক। র্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ (পরে আইজিপি হন), এম খুরশিদ হোসেন ও মো. হারুন-অর-রশিদ, সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমানকেও হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে : কারাগারে পাঠানো ১৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৪ জন কর্মরত আছেন। একজন এখন অবসরকালীন ছুটিতে। তারা হলেন র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে); র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম। ডিজিএফআই-এর সাবেক তিনজন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
ট্রাইব্যুনালের সামনে কড়া নিরাপত্তা : রাজধানীর পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বুধবার সেনা কর্মকর্তাদের হাজির উপলক্ষ্যে সকাল ৬টা থেকে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্যাপক নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সকাল সকাল ট্রাইব্যুনাল বসতে পারে-এজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসে উপস্থিত হন। সকালে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলেছে। ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন-এর বিপুলসংখ্যক সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। এছাড়া কাওরান বাজার, বাংলামোটর, কাকরাইল মোড়সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও টহল দেখা গেছে।
গণমাধ্যমকর্মীকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেওয়ায় এসবির কর্মকর্তাকে পুলিশ কর্মকর্তার হুমকি : সকাল ৭টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের নির্ধারিত পাশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এ সময় সেখানে নিয়োজিত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এসএন মো. নজরুল ইসলাম গেটে দায়িত্বরত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এসআই শহিদুল ইসলামকে সাংবাদিকদের পাশ না দিতে বলেন। এসআই শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের নির্দেশনা আছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাকে জানালে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় নজরুল ইসলাম তার মোবাইল ফোন দিয়ে শহিদুলের ছবি তুলেন এবং চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিএমপি) এসএন নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এসআই শহিদুল ইসলাম আমাকে না জানিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের অনুমতি দেন। আমি তাকে কোনো হুমকি দিইনি।
বিচার প্রক্রিয়াকে ‘স্মুথলি (সুচারুভাবে)’ পরিচালনার বিষয়ে সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে : ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে সেনাবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীসহ এই বিচার প্রক্রিয়াকে ‘স্মুথলি (সুচারুভাবে)’ পরিচালনার বিষয়ে যারা সহায়তা করেছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। তাজুল ইসলাম বলেন, আজ যাদের উপস্থিত করা হয়েছিল, তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে, সোপর্দ করার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন কাজ করেছে; তেমনই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসাবে যাদের মনে করা হয়, সেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই আদালতের প্রক্রিয়াকে সাহায্য করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের সব সমর্থন থাকবে। তারা সেই সমর্থন তাদের (প্রসিকিউশন) দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়েছে। এই আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার ব্যাপারে তারা (সেনাবাহিনী) সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে তাজুল ইসলাম জানান। সেনাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার না করার আহ্বান রেখে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, বিচার প্রক্রিয়াই একটি রাষ্ট্রের সভ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে। একটি রাষ্ট্র কতটা ‘ফাংশনাল’ আছে, সেটা নির্ধারিত হয় সে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কতটা ‘স্মুথলি ফাংশন’ করে। তাই এই বিচার প্রক্রিয়াকে পরিচালনায় যারা সহযোগিতা করেছেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। সেনাবাহিনীকে নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, তারা (সেনাবাহিনী) যেমন জুলাই-আগস্টে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের সময় রুখে দাঁড়িয়েছিল বা মাঝখানে ভূমিকা পালন করেছিল, যেটা জাতি স্মরণ করে; একইভাবে গুমের বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও তারা সহযোগিতা করছে, আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা দেখিয়েছে।
আইনজীবী সরোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ১৫ জন অফিসারের মধ্যে অনেক সিনিয়র অফিসার আছেন। তারা অভিজ্ঞ অফিসার। আন্তর্জাতিক বাহিনীতেও অনেকে চাকরি করেছেন। তারা সবাই আশা করেন, এই আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা কখনোই গ্রেফতার ছিলেন না। আগে সেনা সদর ব্রিফিং করেছিল, সেখানে তারা বলেছে, তারা আর্মি হেফাজতে আছেন। এই মামলাগুলোয় বাকি আসামিদের দিকে ইঙ্গিত করে আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই অফিসাররা অত্যন্ত আত্মবলে বলীয়ান এবং তারা নির্দোষ। তারা কোর্টের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নির্দোষ প্রমাণিত হবেন বলে আশাবাদী। যারা সত্যিকারের অপরাধ সংঘটন করেছেন, তারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন। জেনারেল কবির, জেনারেল আকবর, জেনারেল তারিক সিদ্দিক, জেনারেল মুজিব পালিয়ে গেছেন। এই মামলাগুলোয় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি। এর মধ্যে আল-মামুন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অ্যাপ্রুভার। তিনি বলেছেন, যা কিছু হয়েছে, তা শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের নির্দেশে হয়েছে। এখানে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাদের এ ঘটনার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
সেনানিবাসের সাব-জেলে জেল কোড নিশ্চিত করা খুবই জরুরি : সেনানিবাসের ভেতরে ঘোষিত সাব-জেলে (উপকারাগার) জেল কোড পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দীর্ঘ বছর গুমের শিকার ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম আরমান। তিনি বলেন, সেনানিবাসের ভেতরে যে সাব-জেল রয়েছে, সেখানে জেল কোড ফলো হচ্ছে কি না, যাদের রাখা হয়েছে তারা কোনোভাবে সার্ভিং সেনা সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কি না-এটি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। যদি না হয়, আমরা যারা ভুক্তভোগী ও সাক্ষী আছি, আমাদের জীবনের হুমকি আশঙ্কা করছি। সেনা কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে তিনি এসব কথা বলেন। এদিকে ট্রাইব্যুনালে সেনা কর্মকর্তাদের হাজিরা শেষে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানের সামনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন।

