সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাদ
‘স্বাধীন সংস্থা’ দুদক পরাধীনই থাকল
দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫: সরকারি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েই গেল * তদন্ত-অনুসন্ধান কাজেও কোনো পরিবর্তন ও গতি আসবে না
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সুপারিশ বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। ফলে জুলাই বিপ্লবের পর সংস্কারের মাধ্যমে দুদককে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে রাখার যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা এখন হতাশায় পর্যবসিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এবারও কাগজে-কলমে ‘স্বাধীন সংস্থা’ দুদককে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করে, কার্যত স্বাধীন করা গেল না। সংস্থাটি যেভাবে সরকারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সে সুযোগ রয়েই গেল। রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ এক্ষেত্রেও প্রশ্নবিদ্ধ হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যতটুকু সংস্কার করা হলো তাতে তদন্ত কিংবা অনুসন্ধানেও কোনো পরিবর্তন আসবে না। কাজে ফিরবে না গতি। আগের মতোই তদন্তের দীর্ঘসূত্রতায় দুদকের জাল কেটে বেরিয়ে যাবে দুর্নীতিবাজরা। এছাড়া কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং কাজের জবাবদিহিও নিশ্চিত হবে না। ইতোমধ্যে দুদক অধ্যাদেশের অনুমোদিত খসড়া নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদকের ভেতরে এবং আমলাতন্ত্রের মধ্যে সংস্কারবিরোধী একটি ক্ষমতাশালী চক্র রয়েছে। তারা চায় না দুদকের সংস্কার প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়ন হোক। দুদক কার্যকর হলে চক্রটির স্বার্থে আঘাত আসবে। সংস্থাটি অকার্যকর থাকুক, রাজনৈতিক প্রভাব ও আমলাতান্ত্রিকতার কাছে জিম্মি থাকুক-এটাই তারা চায়। এ কারণে তারা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে নানারকম প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে অধ্যাদেশ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা সংস্কার কমিশনের সার্বিক সুপারিশমালার একটি ক্ষুদ্র অংশবিশেষ। এছাড়া সুপারিশ থেকে আশুকরণীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকার ও দুদক সমন্বয় করে ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সরকার নিজ উদ্যোগেই সেগুলো আমাদের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। কিন্তু সেগুলো কী করা হয়েছে, তা জানা নেই। বরং অনুমোদিত অধ্যাদেশের মাধ্যমে গুড়ে বালি দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবেই এটা হতাশাব্যঞ্জক।’
জানা যায়, কম সময়ে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ শেষ করতে সবচেয়ে বড় বাধা বিভিন্ন সংস্থা থেকে তথ্যপ্রাপ্তি। দুদক কর্মকর্তারা এবার মনে করেছিলেন সংস্কারের মাধ্যমে তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে জটিলতাগুলো রয়েছে, সেগুলো এবার দূর করা হবে। যাতে স্বল্পসময়ের মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করে দুর্নীতিবাজদের আটকে ফেলা যায়, সেজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এবার সমঝোতা চুক্তি করা হবে। সংস্কার প্রস্তাবেও এসব সুপারিশ ছিল। কিন্তু এগুলোর কিছুই করা হয়নি।
অনুমোদিত খসরা অদ্যাদেশটি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, খসড়া অধ্যাদেশটি বিদ্যমান আইনের চেয়ে কিছুটা উন্নত সংস্করণ। এতে দুদক সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশের প্রতিফলনও আছে। তবে সংস্কার কমিশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনোটি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
জানা যায়, কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও কমিশনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংস্কার কমিশন ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করেছিল। এক্ষেত্রে পর্যালোচনা অংশটি বা দুদকের দায়িত্ব পালনে সাফল্য-ব্যর্থতার ষাণ্মাসিক পর্যালোচনার সুপারিশটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
ফলে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সংস্থাটি যেভাবে ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা আর বিরোধী পক্ষকে হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, সে সুযোগ থেকেই গেল। অনুমোদিত খসড়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ শেখ হাসিনার সরকারের পতনে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিমিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসা অন্তর্বর্তী সরকারও সে অবস্থার পরিবর্তন চায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসাবে সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধি মনোনয়নের এখতিয়ার বিরোধী দলের নেতার পরিবর্তে অযাচিতভাবে স্পিকারের হাতে দেওয়া হয়েছে; যা বাস্তবে সরকারি দলের প্রভাব জোরদার করার অশুভ প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয়। একই সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী ও সুশাসনের কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন বাংলাদেশি নাগরিককে কমিটির সদস্য হিসাবে মনোনয়নের দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
কিন্তু তা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত নামের তালিকা প্রকাশের প্রস্তাবিত বিধানটিও বাদ দিয়ে সরকার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে অস্বচ্ছতা এবং সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকেই গেল।
এতে কাগজে-কলমে ‘স্বাধীন সংস্থা’ দুদককে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করে কাযর্ত স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ‘গুড়ে বালি’ দেওয়া হলো। সরকারের এই কাজকে হতাশাব্যঞ্জক বলে অভিহিত করছেন তারা।
আরও জানা যায়, দুদককে গতিশীল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে অভিনবত্ব আনার স্বার্থে কমিশনার হিসাবে নিয়োগের জন্য ‘আইন, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার, শৃঙ্খলাবাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং হিসাব ও নিরীক্ষা পেশায় বা সুশাসন কিংবা দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে নিয়োজিত সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অন্যূন ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার প্রস্তাব করা হয়েছিল; অথচ খসড়া অধ্যাদেশে তা ২৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন করার প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে, যা দুঃখজনক বলছে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বাদ দেওয়া এ ধরনের সুপারিশগুলো প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছে, যা দুদক এবং সরকারের অজানা নয়। তারপরও ইচ্ছামতো সেগুলো বাতিল করা হচ্ছে। কারণ, সম্ভবত সরকার, এমনকি দুদকের ভেতরে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহল এসব বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে। রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের জন্য এটি হতাশাজনক, স্ববিরোধী ও সংস্কারপরিপন্থি নজির।
সরকার নিজেই সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্যের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আবার নিজেই সেগুলো উপেক্ষা করছে।’ সরকারের এমন কাজের সমালোচনা করে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, বিশেষ করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো কোন যুক্তিতে সরকার বা দুদক অবমূল্যায়ন করতে পারে? এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধামাচাপা দিতে পারে?

