একান্ত সাক্ষাৎকারে মেজর (অব.) হাফিজ
৭ নভেম্বর দেশের জন্য বিশাল মাইলফলক
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, ফুটবলার ও দৌড়বিদ। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ভোলা-৩ আসন থেকে পরপর ছয়বার তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাব দিয়েছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরের সঙ্গে ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট, ওই দিনের ঘটনা ও পরবর্তী সময়সহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার তারিকুল ইসলাম।
যুগান্তর : ৭ নভেম্বর রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর প্রেক্ষাপট কি ছিল।
হাফিজ উদ্দিন : ৭ নভেম্বর ও ওই বছরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৫ আগস্ট কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা (দু-একজন অবসরপ্রাপ্ত), দুটি আর্মি ইউনিট, টু ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং প্রথম বেঙ্গল লাঞ্চারের সদস্যরা মেজর রশিদ ও মেজর ফারুকের নেতৃত্বে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেন। এরপর তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বসান। আড়াই মাস মোশতাককে তারা ক্ষমতায় রাখেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে কিছু উলটাপালটা কাজ করে তারা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন। ২৫ আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয় খন্দকার মোশতাকের সরকার। রশিদ, ফারুক ও ১৫ আগস্টে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডকে ধ্বংস করে, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাইপাস করে সেনাবাহিনীতে নানা ধরনের উলটাপালটা কাজ করতে থাকেন। জেনারেল জিয়াকে দিয়ে তারা তাদের পছন্দমতো অফিসারদের বদলি করানোর চেষ্টা করতে থাকেন। বঙ্গভবনে থাকা ১৮টি ট্যাংক জেনারেল জিয়া ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনার লিখিত নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ মেজর ফারুক অমান্য করেন। এতে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবকে হত্যার পর একদল অফিসার উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠে এবং সেনাবাহিনীতে নানা ধরনের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড ঘটায়।
যুগান্তর : সেনাবাহিনীতে কী তখন দুটি গ্রুপ হয়ে যায়?
হাফিজ উদ্দিন : তখন সেনাবাহিনীতে পরিষ্কার দুটি গ্রুপ হয়ে যায়। একটি গ্রুপ হলো মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা। আরেকটি হলো বাকি অফিসাররা; যারা সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফলো করে চাকরি করতে অভ্যস্ত। এক সময় দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘাত চরমে উঠে। এর মধ্যে ৩ নভেম্বর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে এবং খন্দকার মোশতাককে অপসারণ করা হয়। কর্নেল ফারুক-রশিদ ও ১৫ আগস্টে জড়িত অফিসাররা আত্মসমর্পণ করলে ওইদিন তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর একদিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার বাসগৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়।
যুগান্তর : কর্নেল তাহের কি চেয়েছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন : তিন বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে কর্র্নেল তাহের অবসর নিয়েছিলেন। তিনি পঙ্গু ছিলেন। একাত্তর সালে মাইন বিস্ফোরণে তিনি একটা পা হারান। ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনীর মধ্যে তিনি একটি গোপন সৈনিক সংস্থা গড়ে তোলেন। এ সংস্থা ব্যবহার করে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছোট্ট একটি সেনাগোষ্ঠী (যাদের পরিচয় সেনাবাহিনীর কেউই জানত না) লিফলেট বিতরণ করে সাধারণ সেনা সদস্যদের (সিপাহিদের) খেপিয়ে তোলেন। তাদের স্লোগান ছিল-‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। ‘সেনাবাহিনীতে অফিসার কোর থাকবে না, সাধারণ সিপাহিরাই সেনাবাহিনী পরিচালনা করবে। সম্ভব হলে রাষ্ট্রও পরিচালনা করবে।’ এ ধরনের ১২ দফা দাবি তারা প্রণয়ন করেন।
যুগান্তর : ৭ নভেম্বর তুমুল জনপ্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমান কিভাবে মুক্ত হন?
হাফিজ উদ্দিন : ৭ নভেম্বর টু ফিল্ড রেজিমেন্টের কয়েকজন অফিসার যাদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল ফারুক। ১৫ আগস্টে জড়িত রশিদ-ফারুক গ্রুপের সদস্যরা বিমানে ব্যাংকক চলে গেলে তাদের অধীনস্ত সৈনিকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা ভাবেন-১৫ আগস্টে অংশগ্রহণের জন্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে টু ফিল্ড রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈনিক এবং মেজর মহিউদ্দিন নামের একজন অফিসার জিয়াউর রহমানের বাসভবনে প্রবেশ করে তাকে মুক্ত করেন। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন জেনারেল ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে সব সময় আলাদা মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। জিয়াকে বাসগৃহে অন্তরীণ করা, সাধারণ সিপাহিরাও পছন্দ করেননি। এ কারণে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গুটি কয়েক সৈনিক ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান করেন। অভ্যুত্থানটি ছিল অফিসার কোরের সাধারণ অফিসারদের বিরুদ্ধে। অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকরা অনেক অভিযোগ করেন যে তারা সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা করেন। সুতরাং আর অফিসার থাকার দরকার নেই। কর্নেল তাহেরকে ক্ষমতায় বসাতে এভাবে ৭ নভেম্বর বিদ্রোহ করা হয়। এতে প্রধানত অংশ নিয়েছে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী মেজর ফরিদ, মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুকের সৈনিকরা। এভাবে ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান মুক্ত হন।
যুগান্তর : জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পরের ঘটনা কি ছিল?
হাফিজ উদ্দিন : জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর সকালে তার সঙ্গে কর্নেল তাহের দেখা করেন। জেনারেল জিয়াকে জাসদের নেতা কর্নেল তাহের বলেন, আপনি শহীদ মিনারে চলেন, সেখানে জাসদের কর্মীরা এবং সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছেন। তাদের উদ্দেশে আপনি ভাষণ দেবেন। জেনারেল জিয়া তখন চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যস্ত। অফিসারদের অধিকাংশই পলাতক। সেনানিবাসে তাদের ফিরে আসার জন্য জিয়া উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। বিশৃঙ্খল সাধারণ সৈনিকদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে জিয়া প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময়ে কর্নেল তাহেরের শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। জিয়াউর রহমান বলেন, আমি সেনাপ্রধান, আমি রাজনীতিতে জড়াব না এবং আমি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কোথাও যাব না। এ সময় তার সঙ্গে যেসব অফিসার ছিলেন তারাও তাকে সেনানিবাসের বাইরে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কোনো বক্তব্য দিতে হলে রেডিও থেকে রেকর্ডার এনে বক্তব্য রেকর্ড করা যেতে পারে এবং প্রচার করা যেতে পারে। এভাবে ৭ নভেম্বর সকালে দেশবাসীর উদ্দেশে জেনারেল জিয়া বেতার ভাষণ দেন। বেতারের কর্মকর্তারা এসে ভাষণ রেকর্ড করে নিয়ে যান। এ হলো প্রেক্ষাপট। ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর খন্দকার মোশতাককে অপসারণ করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টও খালেদ মোশাররফ ভেঙে দেন। এভাবে আওয়ামী লীগকে পরিপূর্ণভাবে বিদায় করেন খালেদ মোশাররফ।
যুগান্তর : জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। কিভাবে তিনি এনেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন : খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই আওয়ামী লীগের মিছিলে অংশ নেওয়ায় এবং কর্নেল তাহেরের প্রচারপত্র বিলি করায় সাধারণ সৈনিকদের মনে ধারণা হয়-খালেদ মোশাররফ মনে হয় ভারতীয় এজেন্ট। এভাবে তাকে চিত্রিত করা হয়। প্রত্যেক সৈনিক মনে করেন-সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগের বা ভারতের সাহায্যে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করেছেন। এ কারণে মাত্র তিন দিন পর ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পদচ্যুত হন। এদিন সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে অবস্থিত দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেড কমান্ডার নাজমুল হুদা ও চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা অফিসার লে. কর্নেল হায়দার। সেখানেই তাদের বিদ্রোহী সেনারা হত্যা করে। এভাবে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের প্রতিটি ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। ৭ নভেম্বর সৈনিকদের প্রচেষ্টায় জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে আবার সেনাপ্রধান হন এবং সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এ সময় পরিস্থিতি এত বিশৃঙ্খল ছিল যে জেনারেল জিয়া ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তার কথা সৈনিকরা শুনত না। জিয়া তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও সুনামের কারণে অতি কষ্টে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সব সৈনিককে আবার শৃঙ্খলার মধ্যে আনেন। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড তিনি ফিরিয়ে আনেন। এর ফলে সেনাবাহিনী একক ও শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান রূপে এখনো টিকে আছে।
যুগান্তর : কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য কি ছিল?
হাফিজ উদ্দিন : জিয়াউর রহমান তৎকালীন সেনাবাহিনীতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় একজন সেনানায়ক ছিলেন। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি। তিন বছর আগে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। এছাড়া তিনি অপরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মাস তিনেক অংশ নিতে পারেন। তার লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে সাধারণ সৈনিকদের মাধ্যমে অফিসারদের হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। এটি সে সময় মোটেও সম্ভব ছিল না। জিয়াকে তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাহের ও তার দল জাসদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান মনেপ্রাণে অরাজনৈতিক ছিলেন। সে সময়ে তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী জিয়াউর রহমান কখনোই মেনে নেবেন না-এটা উপলব্ধি করার পর তাহের বুঝতে পারলেন তার পক্ষে আর জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করে অভ্যুত্থান করা সম্ভব নয়। তখন জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন কর্নেল তাহের। ৭ নভেম্বর ১৩ জন নিরীহ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে বিদ্রোহী সিপাহিরা। যাদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফ অথবা অন্য কোনো ধরনের অভ্যুত্থানের সম্পর্ক ছিল না। শুধু অফিসার বলেই তাদের হত্যা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা এবং সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতা, কার্যকারিতা ধরে রাখতে চেষ্টা করছিলেন। এজন্য তিনি কর্নেল তাহেরকে কোনো পাত্তাই দেননি।
যুগান্তর : কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টার পরিণতি কি হয়েছিল?
হাফিজ উদ্দিন : সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতো একজন বিশাল ব্যক্তিত্বকে কর্নেল তাহের যখন উৎখাতের চেষ্টা করলেন তখন বাধ্য হয়ে জিয়াউর রহমান তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন। তাহের ও জাসদের নেতাদের তিনি গ্রেফতার করে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করেন। সে বিচারে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। বিপ্লব করার মতো শক্তি সেনাবাহিনীতে তাহেরের ছিল না, সমর্থনও ছিল না। জিয়াকে সরিয়ে তাহেরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব ছিল না। এখানেই তার ব্যর্থতা এবং এজন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
যুগান্তর : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়। ওই সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল না কারও একক কর্তৃত্ব। ফলে সৃষ্টি হচ্ছিল নানা ধরনের সংকট। এরই ধারাবাহিকতায় কী ৩ নভেম্বরের ঘটনা?
হাফিজ উদ্দিন : ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কয়েকটি কারণ ছিল। প্রধান কারণ হলো-১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরে না আসা। বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীতে নিজস্ব অফিসারকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর জন্য জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সৈনিকসুলভ নয়-এমন কিছু কাণ্ড ঘটান অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা। যেমন রেডিও স্টেশনে থাকত ১৫ আগস্টে অংশগ্রহণকারী কিছু সৈনিক। আওয়ামী ঘরানার লোকজনকে ধরে এনে সেখানে তারা মারধর করে টাকা নিত। এটা সেনাবাহিনীতে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে। উদ্ধত আচরণ ও বঙ্গভবনে বসে কয়েকজন মেজরের রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা এবং সেনাবাহিনীর প্রধানকে বাইপাস করে চেইন অব কমান্ডকে বিভ্রান্ত করা হয়। খালেদ মোশাররফের কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। জিয়াউর রহমানের মতো দক্ষ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে গৃহে অন্তরীণ করায় পরবর্তীকালে তিনি আর টিকতে পারেননি। আরেকটি কারণ হলো-আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আওয়ামী শাসনের ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। ১৫ আগস্ট শুধু শেখ মুজিবকে অপসারণ করা হয়েছিল। পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা সবকিছুই আগের মতো ছিল। এসব কারণে ৩ নভেম্বর মোশতাককে সরানো খালেদ মোশাররফের পক্ষে সহজ হয়েছিল।
যুগান্তর : খালেদ মোশাররফ কতদিন সেনাপ্রধান ছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন : খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হিসাবে তিন দিন ছিলেন। এ সময় মোশতাকের সঙ্গে তিনি দেন-দরবার করেই কাটিয়েছেন। চিফ অব স্টাফ পদও তিনি বাগিয়ে নেন। এসব কারণেই সেনাবাহিনীর ওপর তিনি কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। এছাড়া জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করায় সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। এ কারণে খালেদ মোশাররফ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেননি।
যুগান্তর : খালেদ মোশাররফ কিভাবে মারা গেলেন?
হাফিজ উদ্দিন : ৭ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে ‘সিপাহি-সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’-এমন স্লোগান দিয়ে সাধারণ সৈনিকরা যখন বিদ্রোহ করেন তখন খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে ছিলেন। বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা, উত্তরাঞ্চলের ব্রিগেড কমান্ডার ও লেফট্যান্ট কর্নেল হায়দার জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে কর্নেল হুদার একটি ইউনিট দশম ইস্ট বেঙ্গলে তারা আশ্রয় নেন। কর্নেল হুদা সৈয়দপুর থেকে এসে খালেদ মোশাররফের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু একদল বিদ্রোহী সৈনিক যারা হয়তো ওই ইউনিটের মধ্যেই ছিলেন অথবা বাইরে থেকেও আসতে পারেন, তারা কারও নির্দেশে (আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার নয়) খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেন। এখানে জাসদের লিফলেট খুব কার্যকর হয়েছে। তাদের ধারণা ছিল-খালেদ মোশাররফ ভারতের এজেন্ট। তখন আওয়ামী লীগ ঘৃণিত একটি রাজনৈতিক দল ছিল। এ দলের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই মিছিল করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
যুগান্তর : ৭ নভেম্বর দিনটি কেমন ছিল?
হাফিজ উদ্দিন : ১৫ আগস্ট সরকার নয়-আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পর সাধারণ মানুষের কোনো রিঅ্যাকশন দেখা যায়নি। অধিকাংশ মানুষ খুশি হয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সবাই অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর সৈনিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’-স্লোগান দিয়েছেন। এটা আমি নিজেই শুনেছি। ১৫ আগস্টের পরিবর্তনে জনগণ খুশি ছিল। ৩ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরের ঘটনা। এ সম্পর্কে জনগণ কিছুই জানত না। ৩ নভেম্বর রেডিও স্টেশন বন্ধ ছিল। কী উদ্দেশে কারা অভ্যুত্থান করেছেন-এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানতে পারেননি। জাসদের লিফলেটের একটা প্রভাব ছিল। তারা মনে করেন-হতেও পারে এটি ভারত পরিচালিত একটি অভ্যুত্থান। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান সৈনিক ও জাসদের গণবাহিনীর সদস্যরা মিলিতভাবে করেছে। এটি জাসদের পরিকল্পনায় শুরু হয়েছিল। যদিও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন কর্নেল রশিদ এবং ফারুকের সৈনিকরা। অনেক সৈনিক শহরে মিছিল করেছেন। ‘৭ নভেম্বর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’-তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন। ৭ নভেম্বর সম্পর্কে জনগণের কিছুটা ধারণা হয়েছে। ৭ নভেম্বর সৈনিক ও জাসদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষও হয়তো বের হয়েছিল। আমরা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে থাকায় বাইরের পরিস্থিতি দেখিনি। ৭ নভেম্বর সাধারণ মানুষও খুশি হয়েছিলেন বলেই ধারণা করা হয়। কারণ তারাও ভেবেছিল-বোধহয় আওয়ামী লীগের বাকশালী শাসন আবার ফিরে আসতে পারে। এজন্য সাধারণ জনগণ উদ্বিগ্ন ছিল। খালেদ মোশাররফকে সরিয়ে দেওয়ায় সাধারণ জনগণ উৎফুল্ল হয়েছিল। ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থানের দিন। প্রথমত, জনগণ তাকে চিনত স্বাধীনতার ঘোষণাকারী হিসাবে। কয়েক বছর পর ৭ নভেম্বর জনগণ আবার জিয়াউর রহমানের নাম শুনতে পান। সেনাপ্রধান হিসাবে জিয়াউর রহমান রেডিওতে বক্তব্য দিলেন। দেশের জনগণের উদ্দেশে তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেন। তখন কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। জিয়াউর রহমানই কার্যকর সরকার ছিলেন। কোনো ধরনের শূন্যতা, সমাজ তো গ্রহণ করে না। শূন্যতাকে ভরাট করার জন্য তখন দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দলও ছিল না তেমন। সংসদ ভেঙে দেওয়ায় জিয়াউর রহমান স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর তিনি গণভোটের মাধ্যমে তার ক্ষমতায় আরোহণকে বৈধ করে নেন। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় সেনা কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রপতি পদে পেয়ে খুব খুশি হন।
যুগান্তর : ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। মূলত জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। ৭ নভেম্বর কি জিয়াউর রহমানকে এ সুযোগ করে দিয়েছিল?
হাফিজ উদ্দিন : জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক হলেও মনেপ্রাণে একজন গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি আগে কখনোই অংশগ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালেও নিজেকে সৈনিক হিসাবেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় বাধ্য হয়েই তাকে থাকতে হয়েছে। এ সময় এমন কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না যিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বাকশালের কবর দিয়ে তিনি বহু দলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। এর ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক দল আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। জিয়াউর রহমানের প্রচেষ্টায় দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা আরও দৃঢ় হয়। এ কারণে ১৯৭৯ সালে তিনি যে নির্বাচন দেন সে নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও অন্য সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এটি অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন ছিল। এ নির্বাচনে বিএনপি অধিকাংশ আসন পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও অন্য দল থেকে নির্বাচিত হয়।
যুগান্তর : জিয়াউর রহমানের ভালো উদ্যোগই কি রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়?
হাফিজ উদ্দিন : রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পর জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেন-রাষ্ট্র চালাতে হলে গণতন্ত্র ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র কার্যকর রাখতে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারা সৃষ্টি করেন। এ ধারাকে এগিয়ে নিতে এবং বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে তিনি বিএনপি গঠন করেন। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তার দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করে।
যুগান্তর : সময় দেওয়ার জন্য যুগান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
হাফিজ উদ্দিন : আপনাকে এবং যুগান্তরের সব পাঠককে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

