খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করছে। তবে এক্ষেত্রে দুপক্ষের উদ্দেশ্য দুই রকম। আওয়ামী সরকার তথ্য গোপন করেছে লুটপাটের কারণে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে। আর বর্তমান সরকার গোপন করছে আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণের চিত্র যেভাবে বাড়ছে তা প্রকাশিত হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের ঋণ মানের রেটিং আরও কমে যেতে পারে। এমন আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের তথ্য তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এছাড়া গণমাধ্যমের কর্মীরাও বিভিন্ন উৎস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করে। প্রতি প্রান্তিক শেষ হওয়ার পর সাধারণত দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে তা প্রকাশ করা হয়। খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ার কারণে এখন তা পিছিয়ে তিন মাসে গিয়ে ঠেকেছে। গত মার্চ প্রান্তিকের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে জুনে। জুন প্রান্তিকের তথ্য সাড়ে চার মাস পরও প্রকাশিত হয়নি। তবে দু-একটি গণমাধ্যম বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। হালনাগাদ খেলাপি ঋণের তথ্য ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিরূপণ করে। এর মধ্যে মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন পর্যাপ্ততা, প্রকৃত আয়, তারল্য পরিস্থিতি ইত্যাদি সূচকগুলোকে হালনাহাদ করা হয়। এর আলোকে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন হয়। এসব বিষয় মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রেও খেলাপি ঋণের তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে অতি গোপনে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এসব তথ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন সূচকের অবস্থাও মূল্যায়ন করা হয়। খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য গোপন করার কারণে এসব কার্যক্রমও আংশিকভাবে হচ্ছে। গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি প্রতিবেদন। জুন পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এটি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এতে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। এতে মার্চের তথ্য দেওয়া হয়েছে। অথচ এতে জুনের তথ্য প্রকাশ করার কথা। গত জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও মার্চের তথ্য দেওয়া হয়েছিল। ফলে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য আড়াল করে পুরোনো তথ্য দিয়েই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে প্রভিশন সংরক্ষণের চাহিদা, সংরক্ষিত প্রভিশন ও প্রভিশন ঘাটতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ, এর বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ এসব সূচকে মার্চের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ এগুলোর জুনের তথ্য প্রকাশ করা কথা। মঙ্গলবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়নি। জুনের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলেও খেলাপি ঋণের তথ্য দেওয়া হয়েছে মার্চ পর্যন্ত। ওই প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিশ্লেষণী তথ্য-উপাত্ত আড়াল করা হয়েছে। গত মার্চের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত জুনে। এতে ১০ ও ১২নং পৃষ্ঠায় শীর্ষ ৫ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০ ব্যাংকের সম্পদ ও খেলাপি ঋণ পুঞ্জীভূত হওয়ার চিত্র গ্রাফ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এবারের প্রতিবেদনে ১০নং পৃষ্ঠায় কেবল সম্পদের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। খেলাপি ঋণের গ্রাফটি একেবারে হাওয়া করে দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয়, মূলধন, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে খেলাপি ঋণের তথ্য আড়াল করে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণের তথ্য হালনাগাদ করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে দেওয়া হয়েছে। তারা সেগুলো ব্যবহার করে গবেষণা করতে পারছেন। তবে এ তথ্য সাধারণের জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তা প্রকাশ করা হবে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক লুটপাটের কারণে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করা হতো। এর মাধ্যমে লুটপাটের তথ্যও আড়াল করা হতো। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বর্তমান সরকার সব খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা শুরু করে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের তথ্যও প্রকাশ হতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে অর্থাৎ গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়। যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বাড়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা প্রকাশ করছে না। বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কমানো হচ্ছে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার দক্ষিণ এশিয়াসহ অনেক দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। এর পরিমাণ বেশি থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক বার্তা যায়। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে ঝুঁকিমুক্ত খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ৩০ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ব্যাংক খাত ঝুঁকিতে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের সঙ্গে বিশ্বের ভালো ব্যাংকগুলো বৈদেশিক লেনদেন করতে চায় না। করলেও তৃতীয় পক্ষীয় গ্যারান্টি দিতে হয়, তখন গ্যারান্টি বাবদ বাড়তি ফি বা কমিশন দিতে হবে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যায়। পাশাপাশি ঋণ মানের রেটিং কমে যায়। ফলে বৈশ্বিকভাবে ঋণ পেতেও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
