Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

একই দিনে গণভোটকে স্বাগত প্রশ্ন নিয়ে আপত্তি

রাজনীতিবিদদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একই দিনে গণভোটকে স্বাগত প্রশ্ন নিয়ে আপত্তি

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তারা বলেছেন, একই দিন নির্বাচন ও গণভোটের যে কথা বলা হয়েছে-তা দেশের সাধারণ মানুষসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই চাওয়া। তবে গণভোটে চারটি প্রশ্ন রাখার বিষয়টি অনেকটাই জটিল।

সাধারণ মানুষের কাছে এটি আরও সহজভাবে উপস্থাপন করা যেত। নেতারা আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাবে। দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধও অনেকাংশে কমবে। এক্ষেত্রে সবাইকে মিলে ইতিবাচক পথে হাঁটতে হবে।

বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নেতারা এ কথা বলেন। এর আগে দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের আয়োজন করা হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হবে না।

নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের পর বিকালেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫-এ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সই করার পর সেটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ। সাধারণ মানুষ এ ঘোষণায় উৎফুল্ল হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল তা কেটে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সব রাজনৈতিক দল আর কোনো নতুন দাবি উত্থাপন না করে পুরোপুরি নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে দলগুলো যা বলেছে, তা বদলে ফেলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেদের মতো করে একটি সিদ্ধান্ত দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই ‘ভুয়া’ ঐকমত্য কমিশনের কথায় এখন গণভোট হবে। এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সংশয়-সন্দেহ রয়েছে। কারণ একটি মিথ্যা দিয়ে সত্যকে কখনো চাপা দেওয়া যায় না।

জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সাধারণ মানুষ আশা করেছিলেন যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কিভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। কিন্তু তার ভাষণে সংসদ নির্বাচন কীভাবে অংশগ্রহণমূলক হবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বিঘ্নে ভোটের প্রচার চালানো, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি-এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না থাকায় আমরা আশাহত হয়েছি।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামিম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। তার কথায় সমঝোতার ইঙ্গিত রয়েছে। সম্ভাবনার কথাও বলা আছে। আমি মনে করি, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন এবং চলমান দূরত্ব কমিয়ে আনতে পেরেছেন। তিনি আসলে সব পক্ষের চাওয়াই পূরণ করেছেন। তবে সংবিধানে গণভোটের বিষয়টি নেই। বৃহত্তর স্বার্থে এ বিষয়টি সংযোজন করা যেতে পারে। এছাড়াও রাষ্ট্রপতির আদেশে সংবিধান সংশোধনের যে কথা বলা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধানে হাত দেওয়ার ক্ষমতা আর কারও নেই।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, একই দিনে নির্বাচন এবং গণভোট আমাদেরও দাবি ছিল। আমরা তার ভাষণকে স্বাগত জানাই। এখন সব রাজনৈতিক দলের উচিত দেশকে নির্বাচনের পথে এগিয়ে নেওয়া। গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া। আমাদের সবার উচিত পরিবেশ পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত না করে বিভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট একত্রে অনুষ্ঠিত হলে জনগণের মনোযোগ বিভ্রান্ত হবে। গণভোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মানুষ যথাযথভাবে বুঝে মতপ্রকাশ করতে পারবে না। এতে গণভোটের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিঘ্নিত হবে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা আদেশের কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও আমরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এটাকে মেনে নেওয়ার পক্ষে। আমাদের যার যা মত থাকুক না কেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেহেতু সবদিক বিবেচনা করে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসাবে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যালট তৈরিসহ চূড়ান্ত কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন-আমরা মনে করি এটা এখন অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান। সার্বিক বিচারে এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসাবে দেখি। রাজনৈতিক দলগুলোর সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া পথ নেই।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জনগণ ও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে গণভোটের প্রশ্ন চারটি ভাগে ভাগ করে সরকারের দিক থেকে রাষ্ট্রপতির নামে আদেশ জারি করার বিষয়টি নজিরবিহীন এবং অভূতপূর্ব। এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। তিনি হয়তো বিভিন্ন পক্ষকে খুশি করতে চেয়েছেন। আবার বিশেষ কাউকে বাড়তি সুবিধা দিতে চেয়েছেন। আসলে একটি অনির্বাচিত সরকারের এই ক্ষমতা রয়েছে কিনা-তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া গণভোটের প্রক্রিয়াটিকেও জটিল করে ফেলায় ভোটারদের মনে নানা শঙ্কার সৃষ্টি হবে। এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, তা পৃথিবীর অতি বুদ্ধিমান এবং চৌকশ ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব নয়।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, জুলাই সনদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর পরিণতি কখনোই ভালো হবে না।

বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, যেহেতু অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একই দিনে নির্বাচন এবং গণভোটের দাবি করেছে। প্রধান উপদেষ্টাও তার ভাষণে সেই দাবি মেনে নিয়েই কথা বলেছেন। তবে আমরা প্রথম থেকেই শুধু নির্বাচন চেয়েছি। যেহেতু সবাই নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে দাবি করেছে, আমরাও তা মেনে নিয়েছি। তবে গণভোট অনেক বিষয় নিয়ে হয় না। সাধারণত একটি বিষয়ে গণভোট হয়।

ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষের দাবি ছিল একই দিনে নির্বাচন এবং গণভোট। প্রধান উপদেষ্টাও তার ভাষণে এ কথাই বলেছেন। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। এখন উচিত সবাই মিলে নির্বাচনের পথে যাত্রা করা। প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের পর যারা অহেতুক দাবি-দাওয়া তুলে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে, জনগণ নিশ্চয়ই তাদের প্রতিহত করবে।

জাগপা সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। বিলম্ব হলেও বহুল আকাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি আমাদের জন্য আনন্দদায়ক। কিন্তু একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নতুন করে সংকট সৃষ্টি করবে। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ের প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দেশ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম