Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ

মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার মামলার রায় ১৭ নভেম্বর

অন্য দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার মামলার রায় ১৭ নভেম্বর

আগামী ১৭ নভেম্বর জুলাই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলার রায় দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক প্যানেল জনাকীর্ণ আদালতে রায়ের এ দিন ধার্য করেন।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় জড়িত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। কামালও শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে পলাতক।

তৃতীয় আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন হাসিনার নির্দেশে পুলিশবাহিনীকে দিয়ে জুলাইয়ে গণহত্যার দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসাবে আদালতে সাক্ষ্য দেন। ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার দিন এ মামলায় গ্রেফতার একমাত্র আসামি চৌধুরী মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়।

মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, উত্থাপিত অভিযোগ, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং বিচার শুনানির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসিকিউশন বলছে, জুলাই আন্দোলনে দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড ও লাশ পোড়ানোর মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডের প্রধান মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা। প্রসিকিউশন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে শেখ হাসিনাকে গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসাবে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দাবি তাদের।

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ হলো-গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানো। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের তারিখ ঘোষণার পর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আশা করি, ১৭ নভেম্বর আদালত তার সুবিবেচনা ও প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটা ইতি ঘটাবেন। তিনি বলেন, আসামি যত শক্তিশালী হোক না কেন, আইন অনুযায়ী তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি বলে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা খালাস পাবেন বলে প্রত্যাশা করেছেন।

চলতি বছরের ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ তুলে ধরা হয়। বিচার শুরুর পর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ১০৩ দিনে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।

শুনানিতে জুলাই আন্দোলনে শহীদপরিবারের সদস্য, আহত যোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসকসহ ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তাদের বক্তব্যে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতাকে নৃশংসভাবে হত্যা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার গুম-খুনসহ নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্র উঠে আসে।

ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা : বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রবেশে সবার ক্ষেত্রেই আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। সকাল ১০টার দিকে হাইকোর্ট মাজারসংলগ্ন ট্রাইব্যুনালের ফটকে দেখা যায়, সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। বিজিবি ও ডিএমপির সাঁজোয়া যান রয়েছে সেখানে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। এদিন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয় বেলা ১২টায়। এ সময় বিপুলসংখ্যক আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী এবং বিভিন্ন সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।

অঙ্গীকার করেছিলাম, প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে : রায়ের তারিখ ধার্য করার আদেশের পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম যে যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে এবং তাদের আইন অনুযায়ী যে প্রাপ্য, সেটা তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা একটা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি। ট্রাইব্যুনাল এখন চূড়ান্তপর্বে উপনীত হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘এই জাতির যে বিচারের জন্য আকাঙ্ক্ষা, যে তৃষ্ণা, সেটার প্রতি তারা সুবিচার করবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য এই রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে-তেমন একটি রায় আমরা প্রত্যাশা করছি।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত যে ম্যাসাকার (গণহত্যা) এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেই অপরাধের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে, উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে, সেই মামলাটি এখন রায়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) আদালত এ মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর সোমবার দিন নির্ধারিত করেছেন। ইনশাল্লাহ, ১৭ নভেম্বর সোমবার মামলাটির রায় ঘোষিত হবে। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন তিনি।

রায় ঘোষণার দিন ধার্য ঘিরে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, সরাসরি যদি কেউ বিচারপ্রক্রিয়াকে বানচালের জন্য কোনো হুমকি দেন কিংবা কোনো কার্যক্রম করেন, সেটা আদালতের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল।

বিচারকাজ নিয়ে জাতিসংঘে আওয়ামী লীগের অভিযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যারা যা খুশি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন। এই বিচার আমরা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছি, সেটা ট্রান্সপারেন্ট (স্বচ্ছ) ছিল। এখানে অকাট্য ও শক্তিশালী সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। জাতির সামনে এই বিচার হয়েছে। আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুনিয়ার সামনে ক্রিস্টাল ক্লিয়ারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং তারা যত খুশি প্রশ্ন করতে পারেন। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। ন্যায়বিচার নিজস্ব গতিতেই চলবে। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদসহ অন্যরা। শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এছাড়া মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদও ছিলেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম