Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশৃঙ্খল রাজধানীর নাম ঢাকা

বড় ভূমিকম্পের খেসারত দিতে হবে নগরবাসীকে

মতিন আব্দুল্লাহ

মতিন আব্দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বড় ভূমিকম্পের খেসারত দিতে হবে নগরবাসীকে

রাজধানী ঢাকা অপরিকল্পিত এক শহরের নাম। বিশ্বমানের কোনো মাস্টার প্ল্যান ছাড়াই গড়ে উঠেছে একটি দেশের রাজধানী। যেখানে নিয়মকানুনের বালাই নেই বললেই চলে। যে যার মতো ভবন নির্মাণ করছেন এবং তা অব্যাহত আছে। এই শহরে একশ্রেণির প্রভাবশালীদের জন্য সব অনিয়ম জায়েজ। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলেও কিছু হয় না। রাজনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র যাদের বিশেষ স্বার্থে লালনপালন করে। এসব কারণে ঢাকা শহর এখন রীতিমতো কংক্রিটের এক জঞ্জাল। যেখানে নেই কোনো পর্যাপ্ত সড়ক ও খেলার মাঠ। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্প এলাকা কোথায় কীভাবে গড়ে উঠবে-নেই কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। এজন্য নানা অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার নজির এ শহরের পরতে পরতে। নামে রাজধানী হলেও বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও স্যুয়ারেজ লাইন। ফলে ঢাকা এখন এক বিশৃঙ্খল রাজধানী। বিশ্বের বড় শহরের মানদণ্ড সূচকে ঢাকার অবস্থান নিম্নগামী। এমনটিই বলছেন নগরবিদ ও বিশ্লেষকরা। 

তারা বলছেন, এ অবস্থায় এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। ভবনধসে যত লোক মারা যাবে, তার চেয়েও বেশি মরবে অগ্নিকাণ্ডে, আটকা পড়ে। উদ্ধার তৎপরতা চরমভাবে ব্যাহত হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহা. মুসলেহ উদ্দীন হাসান যুগান্তরকে বলেন, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা। অথচ সরকার এ শহরকে ভূমিকম্প সহনশীল না করে ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, এটা মেনে নিতে হবে যে, রাজধানী ঢাকা এখন বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এটি মাথায় রেখে সরকার, পেশাজীবী এবং নগরবাসীকে একযোগে কাজ করা উচিত। মুসলেহ উদ্দীন হাসান আরও বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাথায় রাখলে সরু সড়কের পাশে কখনো ২-৩ তলা উচ্চতার বেশি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হতো না। অথচ সরকার সেটি মানছে না। বরং এখন আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, যে কোনো পরিকল্পিত শহরের জন্য ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। অবশিষ্ট ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, চারশ বছরের পুরোনো শহর রাজধানী ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। এর বিপরীতে অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। প্রতি একরে ১০০ জন থেকে ১২০ জনের বসবাস করার কথা।

অথচ ঢাকায় বর্তমানে প্রতি একরে বসবাস করছে ৪০০ থেকে ৫০০ জন। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চারগুণের বেশি মানুষ বসবাস করছে। 

ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকা শহরে সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় ১৩ দশমিক ৯২ এবং উন্মুক্ত স্থান এক দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বসবাসকৃত এলাকার একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বসবাসকৃত জনঘনত্ব ৫০০ জন। আরও জানা যায়, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে, যা বিশ্বে তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে, যা বিশ্বে দশম। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুরোনো সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ৮২ শতাংশ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। অথচ পরিকল্পিত এবং বসবাস উপযোগী শহরের জন্য ১৫ শতাংশ জলাশয়, ২০ শতাংশ সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গা এবং সড়ক-ফুটপাত থাকা দরকার ২৫ শতাংশ। 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইবেলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা হলো বিশ্বে বসবাস অযোগ্য শহরের মধ্যে সপ্তম। 

দেশের শীর্ষস্থানীয় কাঠামো প্রকৌশলী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া যুগান্তরকে বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিষয়ে ঢাকার কিছুটা প্রস্তুতি থাকলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটলে তা ম্যানেজ করার কোনো সক্ষমতা নেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইনের আগুন ছড়িয়ে পড়বে পুরো নগরীতে। তখন ভয়াবহ অবস্থা দেখা দেবে। ভূমিকম্পে যারা বেঁচে যাবে, তারাও সেখানে টিকতে পারবে না। আগুন, পানি এবং পয়ঃপ্রণালি সিস্টেম বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। সেসব ম্যানেজ করে ঢাকায় বসবাস করা সম্ভব হবে না। 

এদিকে রাজউকের একজন দায়িত্বশীল সিনিয়র কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে কিংবা ঢাকা শহরকে তুলনা করলে অনেক হিসাব মিলবে না। মনে রাখতে হবে, এখানে মোট আয়াতনের চেয়ে জনসংখ্যা অনেক। এ অবস্থায় ৫০ বছর পর ঢাকা শহরের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি মাথায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে। এত মানুষের আবাসন কোথায়, কীভাবে হবে-সেটিও ভাবতে হবে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, অতীতে আমাদের অনেক পরিকল্পনা ভুল ছিল। সরকার বদল হলে যে দেশে পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়ে যায়, সেখানে এর চেয়ে বেশি কী আশা করা যায়। তবে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন আমাদের নির্মাণ করতেই হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে যেটুকু সম্ভব ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম