বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
৬ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের অভাব, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের কারণে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বা ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় সুফল পেয়েছে ধনীরা। জ্বালানি নিরাপত্তা বা অবকাঠামোর অভাবে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে আয় বৈষম্য বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অগ্রগতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. জায়েদি সাত্তারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে তুলনামূলকভাবে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ বদলে গেছে। প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনী মানুষরা। ২০২২ থেকে ২০২৫ সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থবিরতা এবং অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধির মন্থরতার কারণে শ্রম আয়ের সামগ্রিক শক্তি দুর্বল হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২০ লাখ কর্মসংস্থান কমেছে এবং ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা রয়েছে। চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়ায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা পড়েছে নারী এবং তরুণদের ওপর। অতি দরিদ্রদের মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে অনেক দ্রুত হারে। এমনকি করোনাকালের তুলনায় ২০২৫ সালে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এর ফলে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান স্থবির। অনুৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী এবং তরুণরা। প্রতি ৫ জন নারীর মধ্যে একজন বেকার, আর প্রতি ৪ জন শিক্ষিত নারীর মধ্যে একজনের কর্মসংস্থান নেই। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি একেবারে স্থবির। ফলে ১৫-২৯ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীরা প্রায় অর্ধেক কম মজুরিতে কাজ করছেন, যা শ্রমবাজারে চাহিদা ও দক্ষতার মধ্যে অসঙ্গতির ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বেড়েছে। তবে সেখানে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে এবং উপকারভোগী নির্বাচন লক্ষ্যভিত্তিক নয়। ২০২২ সালে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাওয়াদের মধ্যে ৩৫ শতাংশই ধনী পরিবার। যেখানে অতি দরিদ্র পরিবারের অর্ধেকও এই সুবিধা পায়নি। তাছাড়া ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেশির ভাগ সময়ই লক্ষ্যভিত্তিক হয় না। এমনকি বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং সারে সরকার যে ভর্তুকি দেয় তার সিংহভাগ অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারগুলো পায়।
দারিদ্য এবং বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে-এমন ৪টি প্রধান নীতিগত সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হচ্ছে-উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি মজবুত করা। দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য শোভন কাজের ব্যবস্থা করা। আধুনিক প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ ও ব্যবসাসহায়ক বিধিবিধান তৈরি করে দরিদ্রবান্ধব বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শক্তিশালী রাজস্ব নীতি এবং কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।
স্বাগত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেম বলেন, বহু বছর ধরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্যের জন্য পরিচিত। কিন্তু পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, জলবায়ু ঝুঁকি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় শ্রম আয়ও কমেছে। প্রথাগতভাবে দারিদ্র্য হ্রাসের এই গতি বাড়ানো যাবে না। দারিদ্র্য কমানো এবং মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বিশেষ করে যুবক, নারী এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ব্যবস্থা করা। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাইলে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে দারিদ্র্যবান্ধব, জলবায়ুসহিষ্ণু এবং কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ২০১০ থেকে ২০২২ সময়কাল একসঙ্গে দেখা উপযুক্ত হবে না। ২০১০-২০১৬, ২০১৬-২০২২ ও ২০২২-২০২৫-এই সময়কে তিনটি আলাদা ভাগে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়গুলো কেবল সময় নয়-এগুলো রাজনৈতিক অর্থনীতি বদলের সময়, তথ্যের ধরন বদলের সময় এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জও এই সময়গুলোতেই তৈরি হয়েছে। ২০১০-২০১৬ সময়কালে আগের গতির ধারাবাহিকতা ছিল, কিন্তু বদলের আভাস দেখা যাচ্ছিল। ২০১৬-২০২২ সময়কালে নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতি তৈরি হলো। শাসনব্যবস্থা বদলে যায়। অবকাঠামোনির্ভর উন্নয়ন সবকিছুর জায়গা দখল করে। নিয়মভিত্তিক সমাজ দুর্বল হয়। দুর্নীতিকেন্দ্রিক প্রণোদনা ব্যবস্থা তৈরি হয়। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পতন অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকেও দুর্বল করে। ২০২২-২০২৫ সময়কালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব উলটেপালটে যায়। এ সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য প্রায় ২৭ শতাংশে উঠেছে। চরম দারিদ্র্যও বেড়েছে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ২১ লাখ চাকরি হারিয়েছে, যার মধ্যে ১৫ লাখই নারী। এই উলটো ঘুরে যাওয়ার সময়টাকে বুঝতে না পারলে সামনে সঠিক নীতি নেওয়া সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, এই তিন সময়কালকে প্রবৃদ্ধি, সমতা ও সুশাসন-এই তিন লেন্সে দেখা দরকার। যেমন বলা হয়েছে, গ্রামে দারিদ্র্য কমেছে। এর মানে কী গ্রাম প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র, নাকি কম মজুরির কাজের ভিড়। শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, স্থানভিত্তিক বিশ্লেষণেও প্রবৃদ্ধিকে বুঝতে হবে।
ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, দুর্নীতি, রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক, নিরাপত্তা-এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হয়রানি আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের বাস্তব চিত্র। ব্যবসায়ীরা ঘুসের চেয়ে সিদ্ধান্ত না পাওয়াকে বড় সমস্যা মনে করেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা থেকে মানবসম্পদ তৈরি না হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে, ছাত্র বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষা দক্ষতায় পরিণত হচ্ছে না। আরও হাজার স্কিল প্রোগ্রাম নিলেও এই মূল সমস্যার সমাধান না করলে লাভ হবে না।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনাকে আরও গণমুখী করা দরকার মন্তব্য করে ড. জিল্লুর বলেন, অনেকেই এই আলোচনায় অংশ নিতে চান, কিন্তু তাদের কথা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায় না, বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়ও তাদের অগ্রাধিকারগুলো জায়গা পায় না। এখন প্রবৃদ্ধি নিজেই একটি বড় গণতান্ত্রিক এজেন্ডা। এই এজেন্ডা এগিয়ে নিতে রাজনীতির সক্রিয় ভূমিকা দরকার। এজন্য অ্যাকটিভিস্ট, উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের নতুন জোট গঠনের আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মানুষের মানসিক দৃঢ়তা। এটিকে মূল্য দিতে পারলে, কাজে লাগাতে পারলে, সম্মান দিতে পারলে-দেশের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা পালটে যাবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. একে এনামুল হক, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরী।
